শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর গল্প : প্রতীক্ষা

বেলাল চৌধুরী

হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর গল্প : প্রতীক্ষা

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

গাড়িটা তাকে নামিয়ে দিল বুয়েনোস আইরেসের উত্তর-পশ্চিমে সেই রাস্তার চার হাজার চার নম্বর বাড়ির সামনে। তখনো সকাল ন’টা বাজেনি। লোকটা অনুকূল দৃষ্টিতে দেখল ছোপধরা সরল গাছের সারি। প্রত্যেকটি গাছের গুঁড়ি ঘিরে চতুষ্কোণ চত্বর, ছোট ছোট ব্যালকনিঅলা সম্ভ্রান্ত চেহারার বাড়ি, পাশেই ওষুধের দোকান, রং ও লোহার দোকানের জানলার মলিন রুইতন। হাসপাতালের জানালাবিহীন একটি দীর্ঘ পাঁচীল রাস্তার অন্য পাশের ফুটপাথকে আড়াল করে রেখেছে। কিছু গ্রিন হাউসে প্রতিফলিত হয়ে সূর্য আরো নিচে নেমে আসছিল। লোকটা ভাবল এই সবকিছু (বা এখন এলোমেলো, দৈবাৎ ও বিশেষ কোনো ক্রমহীন, স্বপ্নে দেখার মতোই কোনো ব্যাপার) যথাসময়ে— যদি ঈশ্বর করেন— অবশ্যম্ভাবী, প্রয়োজনীয় ও সুপরিচিত হয়ে উঠবে। ডাক্তারখানার জানলায় চিনেমাটির অক্ষরে ‘ব্রেসলাউ-এর’ এই নামটা লেখা হয়েছে। ইহুদিরা বিতাড়িত করেছিল ইতালিয়ানদের, যারা বাস্তুচ্যুত করেছিল ক্রেওলদের। এক হিসেবে এটা ভালোই; লোকটা তার নিজের জাতের সঙ্গে মিশতে চায় না।

গাড়ির চালক তাকে গাড়ি থেকে ট্রাঙ্কটা নামাতে সাহায্য করল; অবশেষে বিমূঢ় কিংবা শ্রান্ত মুখে এক মহিলা দরজাটি খুলে ধরে। চালক তার সিটে বসেই লোকটাকে একটি উরুগুয়ের বিশ সেন্টাভো মুদ্রা ফেরত দেয়, যে মুদ্রাটি মেলোর হোটেলের সেই রাত্রি থেকেই তার পকেটে ছিল। লোকটা তাকে চল্লিশ সেন্টাভো দিয়েই তত্ক্ষণাৎ উপলব্ধি করে : ‘এখুনি আমার এমন কিছু করা দরকার যাতে সবাই আমাকে ক্ষমা করতে পারে। আমি দুটো ভুল করেছি : প্রথমে বিদেশি মুদ্রা ব্যবহার করেছি এবং পরে এই ভুলটা যে আমার কাছে একটা কিছু তা দেখিয়েছি।’

মহিলাটির পিছু পিছু সে সামনের হলঘর-সন্নিহিত প্রথম চাতাল পেরিয়ে ভেতরে আসে। যে ঘরটা তারা তার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিল তার পাশেই ছিল দ্বিতীয় চাতালটি। ভেতরে শোবার লোহার খাটটিকে মিস্ত্রি অদ্ভুত গড়নের ওপর বক্র ছাদে শোভিত করেছে শাখা-প্রশাখা ও লতাগুল্মের বাহারে। এক পাশে ছিল একটা লম্বা পাইন কাঠের ওয়ার্ডরোব, শয্যা-পার্শ্বস্থ টেবিল, ছাদ-ছোঁয়া শেলফে কিছু বই, দুটি কিম্ভূত চেয়ার, একটি বেসিন-সংযুক্ত হাতমুখ ধোয়ার জায়গা, একটি কাচের জার, সাবানদানি আর একটি অস্বচ্ছ ঘোলাটে কাচের বোতল। দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল বুয়েনোস আইরেস প্রদেশের একটা মানচিত্র আর ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি; বিরাট পেখম মেলা ময়ূরের নকশাঘন গোলাপি লাল ওয়ালপেপারের ওপর। একমাত্র দরজাটা খুললেই চাতাল। ট্রাঙ্কটা ভেতরে ঢোকাবার জন্য চেয়ার দুটোর অবস্থান বদল করে নিতে হলো। সবকিছুই তার মনমতো হলো। মহিলাটি তাকে নাম জিগ্যেস করতে সে বলে ‘ভিইয়ারি’, ঐ নামটা সে বলে কোনো গোপন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নয়, এমনকি সে অনুভব করেনি এমন কোনো অপমান লাঘব করার জন্যও নয়, শুধু ঐ নামটাই তাকে এক ধরনের অস্বস্তি দিচ্ছিল আর তাছাড়া ঐ মুহূর্তে অন্য কোনো নামও তার পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না। এটাও নিশ্চিত যে, শত্রুর নাম নেওয়ার মতো চতুর কোনো কৌশলের সাহিত্যসুলভ ভ্রান্ত চিন্তাও তাকে পেয়ে বসেনি।

মি. ভিইয়ারি প্রথম প্রথম ঘর ছেড়ে বেরুতই না, কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলে সে সূর্যাস্তের পর একটু-আধটু বাইরে বেরুতে আরম্ভ করে। একদিন রাত্তিরে সে তিনটে বাড়ির পরে যে সিনেমা হলটি আছে তাতে ঢুকে পড়ে। সে কখনো সিনেমার শেষ সারি ছাড়া কোথাও বসত না; ছবি শেষ হওয়ার একটু আগেই সে বারবার বেরিয়ে পড়ত হল থেকে। ভূতলবাসী (আন্ডারওয়ার্ল্ড) মানুষদের করুণ কাহিনী দেখে সে। নিঃসন্দেহে, এইসব কাহিনীর মধ্যে অনেক ভুল-ভাল থাকে। আবার এইসব কাহিনীর মধ্যে তার পূর্ব জীবনের ঘটনাবলির অনেক সাযুজ্য দেখা যায়। কিন্তু ভিইয়ারি এসব গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। কেননা, বাস্তব ও শিল্পের মধ্যে দৈব মিলের ধারণা তার অপরিচিত ছিল। সবকিছুকেই সে অনুগতভাবে পছন্দ করবার চেষ্টা করত? আর বুঝতে চাইত এইসব কাহিনী দেখানোর উদ্দেশ্য কী। যারা উপন্যাস পড়ে তাদের মতো সে নিজেকে কখনো কোনো উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে খুঁজে পায়নি।

কোনো চিঠি তো দূরের কথা মনে একটা নির্দেশপত্রও তার কাছে আসে না। তবুও সে অস্পষ্ট একটা আশা নিয়ে রোজ সংবাদপত্রের বিশেষ একটা বিভাগ পড়ত। বিকেলের দিকে দোরগোড়ায় একটা চেয়ার টেনে গম্ভীর মুখে সে ‘মাতে’ তৈরি করে নিয়ে ধীরে ধীরে পান করত। তার চোখ আটকে থাকত বেশ কয়েক তলা উঁচু পাশের বাড়ির দেয়াল ঢাকা লতানো গাছে। বহু বছরের নিঃসঙ্গতা থেকে সে শিখেছিল মানুষের স্মৃতিতে সব দিনগুলোই সমান হতে চায়; কিন্তু এমন একটা দিন খুঁজে পাওয়া ভার, তা কারাগারেই হোক বা হাসপাতালেই হোক, যা কোনো বিস্ময় না নিয়ে আসে : একেবারেই কিছু না কিছু বিস্ময়ের স্বচ্ছ বনুনের জালবিহীন অন্য কোনো বিজনবাসের মধ্যে দিন কিংবা প্রহর গোনার লোভ সে সামলাতে পারেনি; কিন্তু এখনকার এই বিবর্তন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যা অন্তহীন যদি না কোনো এক সকালের সংবাদপত্র আলোহান্দ্রো ভিইয়ারির মৃত্যু সংবাদ বয়ে আনে। এটাও সম্ভবপর যে ভিইয়ারি হয়তো ইতিমধ্যেই মারা গেছে, আর তাই যদি হয় তার বর্তমান জীবন একটা স্বপ্ন মাত্র। এই সম্ভাবনা তাকে অস্বাচ্ছন্দ্য দেয়, কারণ সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না এটা স্বস্তি না দুর্ভাগ্য। সে মনে মনে ভাবে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অবাস্তব, সুতরাং তাকে বাতিল করে দেওয়াই ভালো। দূর অতীতের কথা মনে পড়ে তার, খুব বেশি দূর যদিও নয়, অথচ দুটি কি তিনটি ভুলে যাওয়া ঘটনার জন্য এত দূর মনে হয়। প্রমত্ত বাসনা নিয়ে অনেক কিছুই করতে চেয়েছিল সে। তার এই দুর্মর ইচ্ছেগুলো ঘৃণা জাগাত পুরুষদের মনে আর কোনো কোনো নারীর মধ্যে। ভালোবাসা। এখন আর কিছুই কামনা করে না সে; কোনো পরিণামে না পৌঁছে শুধু সহ্য করে যেতে চায়। মাতের স্বাদ, কালো তামাকের স্বাদ, চাতাল ঘিরে জমে আসা ছায়ার রেখা— এসবই এখন তার কাছে যথেষ্ট উদ্দীপক।

এ বাড়িতে একটি বৃদ্ধ নেকড়ে-কুকুর রয়েছে। ভিইয়ারি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। কুকুরটার সঙ্গে সে হিস্পানি ও ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলে, ছোটবেলার গেঁয়ো বুলির যে দু’একটা এখনো তার মনে আছে সেগুলোও সে কুকুরটার কাছে আওড়ায়। ভিইয়ারি স্মৃতিহীন বা প্রত্যাশাহীন সরল বর্তমানের মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। পরবর্তী জীবন থেকে বিগত জীবন তার কাছে কম গুরুত্বের। অস্পষ্টভাবে সে ভাবে তার সমগ্র অতীত ঘটনায় ঠাসা সময়কে সে দেখতে পাবে। এই কারণেই তার কাছে সময় অবিলম্বে অতীতে পরিণত হয়। তার অবসাদ এক একদিন তার কাছে বেশ পরিতৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে আসে। আর এসব মুহূর্তে সে কুকুরটার চেয়ে বেশি জটিল হয়ে পড়ে না।

একদিন রাত্রে হঠাৎ তার মুখগহ্বরে একটা অসহ্য যন্ত্রণা বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে তাকে অবাক করে দেয়। অস্থির হয়ে কাঁপতে থাকে সে। কিছুক্ষণ পরেই আবার সেই আশ্চর্য যন্ত্রণাটা হতে থাকে এবং ভোরের দিকে আবার সে যন্ত্রণাটা অনুভব করে। সকালেই ভিইয়ালারি একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে পাঠায়। ট্যাক্সি তাকে ওনসেতে দাঁতের ডাক্তারখানার সামনে নামিয়ে দেয়। দাঁতটা সে তুলিয়ে নেয়। এই সে অন্য লোকদের চাইতে যেমন বেশি ভীতও হয়নি, আবার তেমনি বেশি শান্তও ছিল না।

আর একদিন রাত্রিতে সিনেমা হল থেকে ফেরার সময় সে টের পেল একটা লোক তাকে ঠেলছে। সে রাগে, ক্ষোভে, একটা গোপন অস্বস্তিতে হঠকারী লোকটার মুখোমুখি দাঁড়ায়। আর মুখ থেকে নির্গত হয় একটা বিশ্রী গালাগাল। লোকটা হতভম্ব হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয় তার কাছে। লোকটা লম্বা, অল্পবয়সী, মাথাভরতি কালো চুল। তার সঙ্গে ছিল জার্মান দেখতে এক মহিলা। সেই রাত্রিতে, বারবার নিজেকে ভিইয়ারি বলতে চেষ্টা করেছে, তারা ওর অচেনা। যাই হোক, চার-পাঁচ দিনের মধ্যে ভিইয়ালারি আর রাস্তায় বেরোয়নি।

শেলফের বইগুলোর মধ্যে এক কপি ডিভাইন কমেডি ছিল। এই সংস্করণটি ছিল আন্দ্রেওলিকৃত পুরনো ভাষ্যসহকারে। নিছক কৌতূহলের চাইতে এক ধরনের কর্তব্যবোধই কাজ করছিল বেশি। তাই ভিইয়ারি এইমাত্র গ্রন্থটি পড়ে ফেলার মনস্থ করে। নৈশ আহারের আগেই একটা সর্গ পড়ে ফেলতে হবে, ভিইয়ারি ঠিক করে এবং পড়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভাষ্যটিও। নরকে শাস্তিগুলো সে অবিশ্বাস্য বা বাড়াবাড়ি মনে করল না। সে ভাবতে পারেনি দান্তে তাকে নরকে শেষ চক্রে দোষী সাব্যস্ত করবে যেখানে উগোলিনোর দাঁত রুগগিয়েরির ঘাড়ে অমোঘভাবে চেপে ধরেছে।

রাত্রিতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের উপজীব্য হওয়ার জন্য গোলাপি লাল ওয়ালপেপারের ওপর ময়ূরগুলো যেন নির্ধারিত হয়ে আছে। কিন্তু মি. ভিইয়ারি কখনো অজস্র জ্যান্ত পাখি জড়ানো অতিকায় গাছ স্বপ্নে দেখেনি। অতি ভোরে সে একটা স্বপ্নের ভেতর আর একটা যা দেখবে যার বিষয়বস্তু হবে একই, শুধু সামান্য অদল-বদল হবে পরিস্থিতির। দুজন লোক আর ভিইয়ারি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বে। তাদের হাতে থাকবে রিভলবার। কিংবা লোক দুটো তাকে সিনেমা হল থেকে বেরুতেই আক্রমণ করবে। অথবা ওরা তিনজনেই তত্ক্ষণাৎ সেই অচেনা লোক হয়ে যাবে যে তাকে ঠেলেছিল। অথবা ওরা বিষণ্ন মুখে চাতালে প্রতীক্ষা করবে তার জন্যে যেন ওকে চিনতে পারছে না। স্বপ্নের শেষে শয্যা পার্শ্বস্থ টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে রিভলবারটা বের করবে (এবং এটা সত্য যে সেই ঐ টেবিলের ড্রয়ারে রিভলবার রেখেছিল) এবং লোক দুটোর ওপর গুলি চালাবে। গুলির শব্দে জেগে উঠবে সে। মনে হবে এসব স্বপ্নমাত্র এবং আর একটা স্বপ্নে দেখবে ঘটনাটি পুনর্বার ফিরে এসেছে। এবং অন্য আর একটা স্বপ্নে তাকে পুনরায় ওদের হত্যা করতে হবে।

জুলাই মাসের এক মলিন সকালে অচেনা লোকের উপস্থিতিতে (সে ওদের দরজা খোলার শব্দ পায়নি) জেগে ওঠে সে। ঘরের ছায়ায় ওদের বেশ দীর্ঘ মনে হচ্ছিল আর অদ্ভুত সহজ-সরল দেখাচ্ছিল ঐ ছায়াতে (ভয়াবহ স্বপ্নের ভেতরও ওদের সব সময়ে বেশ স্পষ্ট দেখাত) সদাসতর্ক, স্থির এবং অবিচল, অস্ত্রের ভারে চোখগুলো যেন আনত, আলেহান্দ্রো ভিইয়ারি এবং আর একটা অচেনা লোক শেষ পর্যন্ত তাকে বিস্মিত করে ধরে ফেলে। একটা ভঙ্গি করে সে ওদের একটু অপেক্ষা করতে বলে দেয়ালের দিকে পাশ ফেরে, যেন আর একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়। যারা ওকে হত্যা করেছিল। সে কি ওদের করুণা জাগানোর জন্যই এরকম করে, নাকি কোনো ঘটনা কল্পনা করা বা তার জন্যে অপেক্ষা করার চাইতে যা ঘটছে তা সহ্য করা অনেক সহজ। এবং এটাই বোধ হয় ঠিক তাতে করে খুনিরা স্বপ্ন হয়ে যাবে, সে রকম তারা বহুবার হয়েছিল, একই জায়গায়, একই সময়ে? সে তখন ঐ মায়াবী স্বপ্নে বিভোর ছিল যখন গুলির শব্দ তাকে মুছে দিল।

 

[নরমান টমাস ডি জোভান্নির ইংরেজি তরজমা অবলম্বনে]

লেখক : কবি।

সর্বশেষ খবর