বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

অর্থনৈতিক কাঠামো বদলানো কি সম্ভব?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

অর্থনৈতিক কাঠামো বদলানো কি সম্ভব?

শিল্পকর্ম : শিল্পী শাহাবুদ্দীন

পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো নিয়ে অস্বস্তি, অসন্তোষ কিংবা ঘোরতর আপত্তি কোনোটাই নতুন বিষয় নয়। সংকট ঘনীভূত হচ্ছে দেখে এই অসন্তোষের মাত্রাও বেড়ে উঠেছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ছুঁই ছুঁই করছে। একই সঙ্গে পৃথিবীর সব সম্পদ হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের কাছে ছুটে চলেছে। সম্পদের পাগলা ঘোড়ার এই একমুখিতাকে কোনো রকমে পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। না, ঠিক বললাম না। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় এই একমুখিতাকে পরিবর্তনের জন্য কোনো চেষ্টাই করা হচ্ছে না। ধরে নেওয়া হচ্ছে এটা পৃথিবীর আহ্নিক গতি বার্ষিকগতির মতোই একটা অপরিবর্তনীয় বিধান। 

অথচ এটা মোটেই সেরকম কোনো প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট বিষয় নয়। আমরা অর্থনীতির যন্ত্রটাকে নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছি। এই যন্ত্র বানাতে গিয়ে কিছু ভুলত্রুটি করেছি বলেই এই পাগলা ঘোড়ার জন্ম হয়েছে। এটা মানুষের সৃষ্ট সমস্যা। মানুষই অতি সহজে এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু তা করছি না কেন? করছি না তার কারণ আমরা এ যন্ত্রের সঙ্গে দৈনন্দিনভাবে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এটাতে কোনো পরিবর্তন করার কথা বললেই ভয় পেয়ে যাই। অথচ আমরা দেখে চলেছি যে, সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর্থিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, জ্বালানি শক্তির সংকট, পরিবেশগত বিপর্যয়, আণবিক বোমা কারটার চেয়ে কারটা কত সহজে ছোড়া যায় তা নিয়ে প্রকাশ্য হুঙ্কার, নিরীহ নাগরিকদের ওপর বিনা বিরতিতে বোমাবর্ষণ, উদ্বাস্তুর ঢল, রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে কিংবা বেড়ে চলেছে। পরাক্রমশালী দেশের নেতা প্রতিবেশী দুর্বল দেশের গরিব মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য তার দেশের সীমান্তজুড়ে দেয়াল তোলার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সৃষ্ট ইউরোপীয় যৌথ রাষ্ট্র কাঠামো থেকে একটা সদস্য রাষ্ট্র বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে এই কারণে যে, যৌথ রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যান্য রাষ্ট্রের গরিব মানুষ যাতে তার রাষ্ট্রে অবাধ ঢোকার অধিকার না পায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে বের হয়ে আসার পর ছেড়ে আসা রাষ্ট্রগুলোর গরিব মানুষকে ঠেকানোর জন্য তারা কঠিন সব ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসবে। কিন্তু এরপর কী? এরপর কি নিজ দেশের গরিব মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের আরও আজগুবি সব ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে?

পুঁজিবাদের মূল কাঠামোকে রক্ষা করতে গিয়ে আমরা অতীতে অনেক কিছু জোড়াতালি দিয়েছি, এখনো দিচ্ছি, বেঁচে থাকার জন্য ভবিষ্যতেও দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকব। তার চেয়ে এই যন্ত্রের মূলকাঠামো সংশোধন করে এসব বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করতে দোষ কী? আমার তো মনে হয় এ কাজটি করার এখনই উপযুক্ত সময়।

আমি দুটি সংশোধনী প্রস্তাব করে আসছি। দুটিরই বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো গ্রহণ করার জন্য বর্তমান যন্ত্রের কিছুই বর্জন করতে হয় না। শুধু দুটি ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ সিদ্ধান্তে পথ বাছাইয়ের সুযোগ দিতে হয়। বর্তমান কাঠামোতে পথ বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই— আমি সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি প্রস্তাব করছি।

এক. প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ একমাত্র স্বার্থপরতার পথে অগ্রসর হতে চায়, এটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। আমি প্রস্তাব করছি, এই একমুখিতা বাদ দিতে হবে। স্বার্থপরতাই একমাত্র পথ এটা ধরে নেওয়াটাই যত সমস্যার মূল কারণ। অথচ মানুষের সামনে দুটি পথ আছে—স্বার্থপরতার পথ এবং স্বার্থহীনতার পথ। তার ইচ্ছা অনুসারে সে পথ চলবে। কেউ চলবে নিখাদ স্বার্থপরতার পথে, যেমন বর্তমানে সে চলে, কখনো সে চলবে নিখাদ স্বার্থহীনতার পথে, কখনো চলবে দুটিকে মিশিয়ে। মজার বিষয় হলো সে এক পথে যেতে চাইলে অন্যপথ তাকে ত্যাগ করতে হবে না। সে ইচ্ছা করলে একই সঙ্গে সব ক’টা পথে, কিংবা যে কোনো একটা পথে চলতে পারবে। সব কিছু তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। কেউ তাকে বাধ্য করবে না। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে শুধু স্বার্থপরতার পথে যেতে বাধ্য করছে বলে যত সব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে এটা সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে।

দুই. অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব মানুষ চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করবে এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল সিদ্ধান্ত। আমার কাছে এটা একটা জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়। আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে মানুষের সৃজনশীলতাকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি। আমি মনে করি মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা। এটা তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতি তাকে জোর করে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে যে, তার জন্ম হয়েছে অন্যের আশ্রয়ে বড় হওয়ার জন্য, অন্যের ব্যবসায়িক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। মানুষকে শুধু অন্যের জন্য ছকবাঁধা দৈহিক এবং মানসিক শ্রম সরবরাহকারী হিসেবে গড়ে তোলা—এটা আমার কাছে মানুষের প্রতি ভয়ঙ্কর অপমানজনক নির্দেশনা বলে মনে হয়, যে নির্দেশনা দেওয়ার অধিকার মানুষের সৃষ্ট কোনো শাস্ত্রের নেই।

এক্ষেত্রে আমার সংশোধনী প্রস্তাব হলো প্রত্যেক মানুষ নিজেই স্থির করবে সে চাকরি করবে নাকি উদ্যোক্তা হবে। সমাজ তাকে তার পথ বাছাই করার সুযোগ দেবে, সে পথে চলা সহজ করার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাগুলো করে দেবে।

প্রথম প্রস্তাব অনুসারে স্বার্থপরতার সঙ্গে স্বার্থহীনতাকে স্বীকৃতি দিলে অর্থনীতিতে এমনকী পরিবর্তন আসবে যেটা একটা বড় রকমের প্রভাব ফেলবে সমাজে? এই স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন ধরনের ব্যবসার জন্ম দেবে। বর্তমানে যে ব্যবসা প্রচলিত আছে সেটা হলো স্বার্থপরতা-ভিত্তিক ব্যবসা-ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনই হলো এর মূল লক্ষ্য। স্বার্থহীনতাকে স্বীকৃতি দিলে তার বহিঃপ্রকাশের জন্য আরেক ধরনের ব্যবসার সৃষ্টি হবে—ব্যক্তিগত মঙ্গলের জন্য নয়, মানুষের মঙ্গলের জন্য ব্যবসা। ব্যক্তিগত মঙ্গল কামনাকে এ ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে বিবেচনার বাইরে ঠেলে দেবে। আমি ব্যবসার নাম দিয়েছি সামাজিক ব্যবসা। মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য এই ব্যবসা পরিচালনা করা হবে।

মৌলিক বিচারে প্রথাগত সব ব্যবসার একটিই লক্ষ্য—বিনিয়োজিত অর্থ থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। সামাজিক ব্যবসা একেকটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা। ব্যবসায় লোকসান না দিয়ে সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করাই এ ব্যবসার লক্ষ্য। সামাজিক ব্যবসার কৌশল নির্মাণে তাই ব্যাপক সৃষ্টিশীল শক্তির প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন সামাজিক ব্যবসা নির্মাণকারী এমন কিছু সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন যার অস্তিত্ব আগে ছিল না। এ জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ সৃজনশীলতার। আর এ জন্যই কাজটা এত উত্তেজনাকর। সামাজিক ব্যবসা মানব সমাজের বিভিন্ন সমস্যা দূর করার একটি অত্যাবশ্যকীয় উপায়ই কেবল নয়, এটি মানুষের সৃষ্টিশীলতার উত্তম প্রকাশও বটে—সম্ভবত মানুষের শক্তি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ রূপ।

সামাজিক ব্যবসা আত্ম-আবিষ্কারের, আত্মোপলব্ধির এবং আত্ম-ব্যাখ্যার একটি শক্তিশালী পথ। সর্বোপরি এই ব্যবসার সামাজিক ফলাফলগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করলে—পুষ্টিহীন শিশুরা স্বাস্থ্যবান হতে শুরু করলে, উপার্জনহীন মানুষ উপার্জনে যুক্ত হয়ে পড়লে, রোগাক্রান্ত মানুষ সুস্থ হলে যে অনাবিল আনন্দ হৃদয়কে পরিপূর্ণ করবে আর কোনো কাজ সে আনন্দ দিতে পারে কিনা আমার সন্দেহ হয়। একটি সামাজিক ব্যবসা কল্পনা করা এবং সেটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মধ্যে যে সৃষ্টিশীল আবেগ কাজ করে, পৃথিবীর আর কোনো প্রাপ্তির সঙ্গে তার তুলনা হয় না। আর এ জন্যই সামাজিক ব্যবসায় একবার সফল হলে কেউ তার থেকে সরে আসার কথা  চিন্তা করতে পারে না।

আমার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি নিয়ে কিছু বলি। এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে সব মানুষই উদ্যোক্তা। তাকে উদ্যোক্তা হওয়ার সব সুযোগের দুয়ার খুলে দিতে হবে। এখন তার কাছে এই দুয়ার সম্পূর্ণ বন্ধ। যেমন নতুনভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এখন সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো যে যত বেশি সম্পদশালী তাকে আরও সম্পদশালী করা। কারণ তাতে মুনাফা বেশি।

নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক ব্যবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তাদের লক্ষ্য হবে সব তরুণ-তরুণীকে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য পুঁজি ও সব রকম আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে তরুণদের জব-রেডি হিসেবে তৈরি না করে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করে দেওয়া এবং সহায়ক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া।

এই দুটি প্রস্তাব গ্রহণ করা গেলে সম্পদের কেন্দ্রীভূতিকরণের পরিবর্তে সম্পদের সুষম বণ্টনের দিকে অর্থনীতি অগ্রসর হবে। যেহেতু সামাজিক ব্যবসায় কেউ ব্যক্তিগত মুনাফা নেয় না, যতই সামাজিক ব্যবসা বাড়বে, বিশেষ করে সম্পদশালীদের মধ্যে, ততই সম্পদ কেন্দ্রীভূতিকরণের গতি  কমতে থাকবে।

যতই তরুণরা উদ্যোক্তা হতে আরম্ভ করবে ততই সম্পদের কেন্দ্রীভূতিকরণের শক্তি কমতে থাকবে। এই শক্তি কমে এসে সম্পদের গন্তব্য ঊর্ধ্বমুখী না করে নিম্নমুখী করে দিতে পারে। তার কারণ স্পষ্ট। তরুণরা যতই উদ্যোক্তা হতে থাকবে ততই নতুন সৃষ্ট সম্পদের ওপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সে নতুন সম্পদ সম্পদশালীদের কুক্ষিগত হওয়ার সুযোগ পাবে না। 

অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সম্ভব। বর্তমান কাঠামো পৃথিবীকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিপর্যয়ের পথে অগ্রসর না হয়ে আমাদেরই কল্পনায় রচিত স্বপ্নের পৃথিবী আমরা বাস্তবে রূপ দিতে পারি। নতুন পথ রচনা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ।

সর্বশেষ খবর