বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি

আমার প্রয়াত সাংবাদিক বন্ধু এ বি এম মূসার কাছে গল্পটি শুনেছি। মূসা এক সময় লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টাইমস-এর তখনকার সম্পাদকের সঙ্গে তার ছিল ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা। এই সম্পাদক তখন ছিলেন ব্রিটেনের একজন জাঁদরেল সম্পাদক। এখন অবসর নিয়েছেন (বয়সের ভারে তার নামটা ভুলে গেছি)। মূসা তাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি প্রথম যৌবনে কাগজ সম্পাদনা শুরু করে ব্যর্থ সম্পাদক হয়েছিলেন বলে থাকেন। কিন্তু এখন আপনি সারা বিশ্বে পরিচিত একজন সফল সম্পাদক। আপনার এ সাফল্যের পেছনে কারণটা কি?

সম্পাদক হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘আমি ২৫ বছর বয়সে প্রথম সংবাদপত্রের সাংবাদিক হই। ৪০ বছর বয়সের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাগজ সম্পাদনা শুরু করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। এখন ৪০ বছর বয়সে আমি ২৫ বছর বয়সের তরুণের দৃষ্টি নিয়ে সংবাদপত্র সম্পাদনা করছি এবং পাঠকদের মন জয় করে সফল সম্পাদক হয়েছি।’’

এবার আমি নিজের জানা একটি গল্প বলি। ১৯৫৪ সাল। ঢাকায় ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ কাগজটি আগের বছর বের হয়েছে। মাত্র চার পৃষ্ঠার কাগজ। কোনো নামিদামি লেখকের লেখা থাকে না। পত্রিকাটির একমাত্র আকর্ষণ মোসাফির ছদ্মনামে লেখা কলাম ‘‘রাজনৈতিক মঞ্চ’’। প্রতিযোগী মুসলিম লীগ সমর্থক দৈনিকটি তখন প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র। পৃষ্ঠায় এবং লেখাজোকায় খুবই ভারী। তথাপি চার পৃষ্ঠার দৈনিকটি তখন প্রচার সংখ্যায় প্রতিষ্ঠিত দৈনিকটিকে প্রায় ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।

কারণটা কী? কিছু দিনের মধ্যে নিজেই তা বুঝতে পারলাম। ১৯৫৪ সাল ছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনের বছর। শাসক মুসলিম লীগ দল নির্বাচনে জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পেরে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর বোন মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেছে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারকার্য চালাতে। তাদের ধারণা, কায়েদে আজমের বোন হিসেবে তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্রী। সুতরাং তার কথায় পূর্ব পাকিস্তানের ভোটদাতারা প্রভাবিত হবে।

করাচি থেকে বিমানযোগে ফাতেমা জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন। ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক তখন জাঁদরেল সাংবাদিক এবং পরবর্তীকালে ’৭১-এর শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেন। তিনি তার সহকারীদের সঙ্গে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন, কীভাবে ফাতেমা জিন্নাহর ঢাকা আগমনের খবরের একটা জুতসই হেডিং দেওয়া যায়, যাতে ফাতেমা জিন্নাহর প্রতি কোনো অমর্যাদা দেখানো না হয়, আবার মুসলিম লীগের পক্ষে তার নির্বাচনী প্রচার সফল না হয়।

এ সময় বার্তা কক্ষে সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আকস্মিক আবির্ভাব। তিনি বার্তা বিভাগের সবাইকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী, আপনারা কী নিয়ে এত চিন্তাভাবনায় পড়েছেন? মানিক মিয়া কাগজটির সম্পাদক বটে, কিন্তু পেশাদারি সাংবাদিকতায় তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সুতরাং সবাই ভাবলেন, খবরের জুতসই হেডিং তৈরির ব্যাপারে তিনি কি আর সাহায্য জোগাবেন? তবু সমস্যাটির কথা তাকে জানানো হলো। তিনি হেসে উঠে বললেন, এটা নিয়ে এত চিন্তা করছেন কেন? খবরটার হেডিং দেন, “ঢাকায় ফাতেমা জিন্নার হাওয়াই হামলা”। তার কথা শুনে সবাই চমত্কৃত। ওই হেডিং দিয়ে পরদিন কাগজ বেরুল। ইত্তেফাকের এক স্টাফ ছিলেন বশীর মিয়া। তিনি ইত্তেফাক হাতে সারা ঢাকা শহরে চিৎকার করে বেড়ালেন, “ঢাকায় ফাতেমা জিন্নার হাওয়াই হামলা-হাওয়াই হামলা।’’ কাগজটির কয়েক হাজার কপি সন্ধ্যার আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

নয় বছর আগে দৈনিক কালের কণ্ঠ মিডিয়া গ্রুপ থেকে যখন আরেকটি বাংলা দৈনিক “বাংলাদেশ প্রতিদিন” বের হয়, তখন বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, কালের কণ্ঠের মতো একটি আধুনিক সুষ্ঠুমানের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক থাকা সত্ত্বেও এই গ্রুপ কেন একটু কম দামের আরেকটি বাংলা দৈনিক বের করছে? জবাবটা পেলাম বেশ কিছু দিন পর। লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছি। বিমানবন্দর থেকে শহরে যাচ্ছি। রাস্তায় ভীষণ যানজট। মাঝে মাঝেই আমার গাড়ি সেই যানজটে কোথাও পাঁচ মিনিট, কোথাও দশ মিনিট, কোথাও আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় ভিক্ষুক থেকে শুরু করে নানা ধরনের পণ্য বিক্রেতা গাড়ির চারপাশে ভিড় জমায়। তাদের মধ্যে সংবাদপত্র এবং নানা ধরনের ম্যাগাজিন হাতে বহু কাগজ বিক্রির হকারও থাকে।

একদিন বিমানবন্দর থেকে শহরে যাওয়ার পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া গাড়িতে বসে এই হকারদের কণ্ঠে চিৎকার শুনলাম, “চাই বাংলাদেশ প্রতিদিন, চাই বাংলাদেশ প্রতিদিন।” এক হকারকে ডেকে সেদিনের একটা কাগজ দিতে বললাম। তরুণ হকার প্রথমেই “বাংলাদেশ প্রতিদিন” বের করল। জিজ্ঞাসা করলাম, আর কোনো দৈনিক নেই? হকার বলল, আছে। তবে এই কাগজটিই বেশি চলে। তাই দিলাম। ঢাকায় যে দৈনিকটি দাবি করে প্রচার সংখ্যায় সে শীর্ষে তার নাম উল্লেখ করতেই হকার বলল, ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন তার চাইতেও বেশি চলে।’ তার কথা প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পরে জেনেছি, এই হকারের কথাই সত্য। ঢাকায় আরও দু-একটি কম দামের বাংলা দৈনিক আছে, কিন্তু প্রচার সংখ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারেকাছেও নেই। এর কারণ কী? ঢাকায় যে কদিন ছিলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন হাতের কাছে পেলেই পড়েছি এবং কারণটা জেনেছি।

কাগজটির বৈশিষ্ট্য সহজ ভাষায় ছোট খবর ও খবর ভাষ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে সব দলের খবর প্রকাশ এবং তাদের মতামত প্রকাশে সুযোগ দান। পাঠককে জ্ঞানদান বা তাদের মতামত প্রভাবিত করার চেষ্টা কাগজটিতে নেই। আছে পাঠককে আলোকিত করার চেষ্টা। পত্রিকাটির সম্পাদক নঈম নিজামকে একজন তরুণ সম্পাদকই বলা চলে। তিনি কী করে কাগজটিকে এত পাঠকপ্রিয় করেছেন, সে প্রশ্ন মনে জাগতেই বন্ধু এ বি এম মূসার কাছে শোনা লন্ডনের ‘টাইমস’ কাগজের সম্পাদকের কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে ইত্তেফাকে একদা সম্পাদক মানিক মিয়া কর্তৃক খবরের হেডিং দেওয়ার কথা।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি যদি বুঝতে হয় তাহলে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর সাংবাদিকতার ইতিহাস জানতে হবে। স্বাধীনতা-পূর্ব দেশের সাংবাদিকতা ছিল দল ও দলীয় রাজনীতির আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ক্ষমতাসীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ শক্তি ছিল বেশি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেই সাংবাদিকদের বেশি লড়তে হয়েছে। সংবাদপত্রের মালিকানাও ছিল মূলত রাজনৈতিক দল বা নেতার হাতে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সংবাদপত্রের মালিকানা রাজনীতিকদের হাতে আর নেই। সরকারের নিয়ন্ত্রণও শিথিল। সংবাদপত্রের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়েছে নব্য ধনী ও বিগ বিজনেসের কাছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিকদের সংগ্রামের চরিত্রও তাই বদলে গেছে। এই সংগ্রাম এখন বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি বৃহৎ মিডিয়া গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে, এখানেই তার সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য। তার দীর্ঘায়ু এবং সাফল্য দুটোই কামনা করি।

লন্ডন, ১২ মার্চ, সোমবার, ২০১৮।

 

লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর