বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বৃহৎ সমাজ জীবনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

বৃহৎ সমাজ জীবনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে

শিল্পী আব্দুস শাকুর শাহ্

মানুষ নিজের আমিত্বর বাইরে যেতে ব্যর্থ হলেই অহংবোধের সৃষ্টি হয়। অহংকার পতনের মূল। একমাত্র অহংকারই মানুষের ভিতরের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে পশুত্বের জাগরণ ঘটায়। মাঝে মাঝে আমিও যেমন চেম্বারের রোগীদের চাপ সহ্য করতে না পেরে কিংবা বাইরের রোগীদের জটলার জন্য কাজের বিঘ্ন ঘটলে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাই। এটা কি আমার অহংকার না বিরক্তি? অবশ্যই যখন পারি না, তখন হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে বাইরে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর রোগীদের মধ্য শৃঙ্খলা ফিরে এলে আবার চেম্বারে আসি অথবা গ্রীন লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাহায্য নিই।

চেম্বারে বিশৃঙ্খলার কারণ, রোগীদের অনেকে যারা আগে থেকে সময় নেন না, নাম লিখেন না, তারা একটা ভিজিটিং কার্ড অথবা পরিচয় ব্যাখ্যা করে একটা স্লিপ দেন। চেম্বার সহকারীদের এটা গ্রহণ না করা এবং আমার কাছে না পৌঁছানোর কোনো বিকল্প নেই। কেননা এসব ক্ষমতাসীন ব্যক্তি চেম্বার সহকারীদের ধমক দিয়ে হতবাক করে দেবেন। এটাও কিন্তু তাদের অহংবোধ। তাদের ক্ষমতা ও অহংবোধের কাছে চিকিৎসক হিসেবে আমিও অসহায়। আমি প্রায়ই বলে থাকি, ‘প্রার্থনা করতে গিয়ে যদি কোনো ভুল হয় তা সংশোধন করা সম্ভব। কিন্তু রোগীর রোগ নির্ণয়ে ভুল হলে, ভুল ব্যবস্থাপত্র দিলে, যে ফল দাঁড়াবে তা সংশোধন করা সম্ভব নয়।’

আমার এক অতি নিকট আত্মীয় দিনে তিনবার ঠাকুরের আসনের সামনে বসে উপাসনা করতেন, তার স্ত্রী আমাদের অতি আদরের ঠাকুরমা। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার নিয়ে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে তিনি তীব্র ক্ষোভ ও রাগ প্রকাশ করতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, কিসের প্রার্থনা, ওই খানে বসে টাকা-পয়সার হিসাব মেলায়। আমরা যে না খেয়ে বসে থাকি, সেদিকে কি লক্ষ্য আছে। বাঙালি সমাজের রেওয়াজ স্বামীকে না খাইয়ে স্ত্রী কি করে খাবে? একদিন সত্যি সত্যিই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদু তুমি এক ঘণ্টা ধরে ঠাকুরের কাছে কি মন্ত্র পাঠ কর অথবা কি বর প্রার্থনা কর, নাকি সত্যি সত্যিই ঠাকুরমা যে বলে তুমি সেখানে বসে টাকা-পয়সার হিসাব, ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব মেলাও তা কি সত্যি। দাদু তুমি কিন্তু আমাকে সত্যি বলবে। আমিও যেন এখন থেকে তোমার মতো দীর্ঘ সময় প্রার্থনা করতে শিখি। বিষদ কিছু না বলে স্বীকার করলেন ঠাকুরমার কথা আংশিক সত্যি। আরও বললেন, তোমাদের এ বয়সে এত প্রার্থনার দরকার নেই, তোমাদের জন্য ‘ধর্মের চেয়ে কর্ম বড়’। ছাত্রদের ধর্ম লেখাপড়া। ধর্মে বিশ্বাস রেখে কঠোর পরিশ্রম ও কর্ম করে যাও তাহলে অনেক বড় হতে পারবে। আমি ধর্মে বিশ্বাসী, প্রার্থনা করি তবে ৫/১০ মিনিটের বেশি নয়, কিন্তু কর্মকে আত্মীকরণ করতে চেষ্টা করছি।

তাপস বসুর লেখা ‘অহংবোধ থেকে মুক্তির পথ’ সাধক কবি গায়ক রামপ্রসাদ সেন মধ্যযুগের অন্তিমে অবক্ষয়িত সমাজ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে তার উপাস্য দেবীর কাছে ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়ে নিজের উত্তরণের পথ খুঁজেছিলেন। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’। প্রায় এক শতাব্দী পরে নবজাগরণের বহুমুখী ব্যাপ্তির কালে নিজের জন্য নয়, আত্মবিশ্বাসহীন পরপদানত গণজীবনে চৈতন্যের জাগরণের জন্য আকুল আহ্বান জানিয়েছেন শ্রী রামকৃষ্ণ। সমকালীন জীবনায়নে এই চৈতন্যের অভাব প্রবল পীড়িত করেছে তাকে। সচেতনতার অভাব থেকেই দেখা দেয় বেহিসাবি অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার। সেই সঙ্গে অহমিকা-বাগাড়ম্বর-নীতিহীনতা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। তাই কাছের-দূরের সবার চৈতন্যের জাগরণের ওপর তার গুরুত্বারোপ, যা আজকের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রী রামকৃষ্ণ বারবার সবার মাঝে জীবনের উদ্দেশ্যরূপে ঈশ্বরলাভের কথা বলেছেন। এই ঈশ্বরলাভ আসলে আত্মজ্ঞান লাভ, যা চৈতন্যেরই নামান্তর। এই আত্মজ্ঞানে অধিকারী হলে মানুষের জীবন সুস্থ ও সুন্দর হয়ে ওঠে। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে জগৎ জীবনের সংযুক্তিতে, সংশ্লেষণে যথার্থ সচেতনতার আলোয় দাঁড়িয়ে মানুষ উদার ও মহৎ হয়ে উঠতে পারে। পারে তার অস্তিত্বের অন্দরে আনন্দঘন দৃষ্টির সম্প্রসারণ ঘটাতে। মানুষের মধ্যে তখনই ‘আত্মদীপো ভব’ বাস্তবায়িত হয়। নিজের মধ্যে, অপরের মধ্যে, সর্বপরি সবার মধ্যে আলো জ্বলে ওঠে। ‘কাঁচা আমি’র অন্ধকার সরে যায়, জেগে ওঠে ‘বড় আমি’। ‘ছোট আমি’র আবরণ খসে গিয়ে ধরা দেয় ‘বড় আমি’। সক্রেটিসের ভাষায় ‘রিলেটিভ ট্রুথ’-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্টারনাল ট্রুথ’। এর বিহনে সহিষ্ণুতার অভাব, সহনশীলতার অভাব প্রকট হয় ব্যক্তিজীবন তো বটেই, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনেও—যা অনেকাংশেই খর্ব করে মানবতাকে।

অহেতুক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলে প্রধান হয়ে ওঠে আমিত্ব। শুধুই ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা। কুয়োর ব্যাঙ ও সমুদ্রের ব্যাঙের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বোঝান যে, সংকীর্ণ কুয়োর ব্যাঙ জানেই না, সমুদ্র কত বড়! তবু তার আস্ফাালন কমে না। তেমনই সংকীর্ণ মনোভাবের মানুষজন বৃহত্তর জীবনবোধ ধর্মবোধের হদিস পায় না। সমুদ্রের পাড়ে বসেও তাই কূপ খনন চলে তাদের, অধরাই থাকে ভূমা-বৃহৎ। ‘মান’ ও ‘হুঁশ’-এর সংযুক্তিতে যে বৃহত্তর মানবচেতনা, সেটিই দেশ-কালের প্রেক্ষিতে একান্ত অভিপ্রেত-অভীপ্সিত। অথচ আমরা তা বুঝেও বুঝি না। এটিই আক্ষেপের, দুঃখের।

কিন্তু আমিত্বের উপর উঠতে মানুষ যদিও সান্নিধ্যের মধ্যে থাকা লোকদের চেয়ে নিজেকে অন্য আঙ্গিকে ভাবেন তাহলেই তিনি আমিত্বের ক্ষুদ্র কুয়োর ভিতরে নিজেকে বন্দী করে ফেলেন, তেমনি ঈশ্বরের কাছে থেকে এবং আলোকিত পৃথিবী থেকে নিজেই অন্ধকার গুহাতে স্বেচ্ছা নির্বাসিত হন। তাই কোনো কিছুতেই ‘আমি নই, আমাদের’। অনাড়ম্বর, নিরহংকারী, আন্তরিক ভালোবাসা জড়ানো জীবন ছন্দ যখন খুঁজে পাবেন তখনই আমিত্বের ওপরই হবে আপনার স্থান। মনে রাখতে হবে, প্রেম-ভক্তি-প্রীতি-সেবা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-নিত্য-অনিত্য সবই দরকার বাঁচার জন্য, সমাজের জন্য।

সীমা সংহত জীবনের মধ্যে ও অনন্তের আস্বাদ তা মনে থাকলেই, হৃদয়ে ধারণ করলে সমাজের অনেকেই আপনার কাছে ছুটে আসবে আবার আপনি যদি ওদের চাহিদাতে অহংকারী হন তাহলে পাপের দিকেই ধাবিত হবেন। পণ্ডিত জ্ঞানী হলেই হবে না, মনকে উদার করতে হবে, বৃহৎ সমাজ জীবনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে, সংকীর্ণ স্বার্থপরতার গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর