বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবার জন্য আবাসন

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

সবার জন্য আবাসন

শিল্পী আব্দুস শাকুর শাহ্

বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই আবাসন তথা বাসস্থান পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। খাদ্য, আবাসন তথা বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। খাদ্য সংগ্রহের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি মানুষ প্রথমেই খোঁজে একটি আশ্রয় তথা মাথার ওপর একটি ছাদ।

উন্নয়নশীল দেশে প্রতিনিয়ত একজন মানুষ তার আদি বাসস্থান গ্রাম বা মফস্বল শহর ছেড়ে ছুটে আসে বড় বড় শহরে কাজের খোঁজে ও পাশাপাশি উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন নিয়ে। আর প্রথমেই তাকে খুঁজতে হয় মাথার ওপর একটি ছাদ তথা আবাসন তথা বাসস্থান। প্রাথমিকভাবে সে মানুষটি সাধারণত আবাসন তথা বাসস্থান পাওয়ার প্রচেষ্টা চালায় সাপ্তাহিক বা মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে। এই চলমান অবস্থায় রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতি বছর নতুন আবাসন তথা নতুন ফ্ল্যাটের প্রয়োজন এক লাখের ঊর্ধ্বে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরাঞ্চলে আবাসনের আওতায় কমবেশি ৫০ শতাংশ বাসস্থান তথা বাড়িঘর ব্যক্তি মালিকানাধীন, কমবেশি ৪০ শতাংশ ভাড়াটিয়া ও প্রায় দুই শতাংশ অবৈধ দখলের মাধ্যমে ব্যবহূত। আবাসন খাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন গৃহায়ন প্রবৃদ্ধির হার আনুমানিক আট শতাংশ এবং একই সঙ্গে ভাড়াটিয়ার প্রবৃদ্ধির হার আনুমানিক প্রায় পাঁচ শতাংশ।

আবাসন ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। বিশ্বের সর্বত্রই আবাসন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার হাত ধরেই বিকশিত হয়। উচ্চ শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের গুণগতমানের পরিবর্তন হওয়া শুরু হয় আবাসনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি। একই সঙ্গে বিকশিত হওয়া শুরু হয় নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় শিল্পসম্ভারের। সমগ্র দেশে গড়ে ওঠে অসংখ্য সাধারণ থেকে ভারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান। আবাসন বিনির্মাণে যে শিল্পসম্ভারের প্রয়োজন নিত্যদিনের, তার বিকাশ ও উন্নয়নে গতি আনে আবাসন শিল্পের চাহিদা ও প্রাপ্তির নিশ্চয়তার মাধ্যমে।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী শ্রেণির বিপুল আবাসন চাহিদা, যা মেটাতে প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো। বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা সমাধানে প্রধান দায়িত্ব নিয়ে থাকে সরকার। যা বাংলাদেশে প্রায় একেবারেই অনুপস্থিত। যার পরিণতিতে রাজধানীসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সারা বাংলাদেশে এখনই সরকারি ও বেসরকারি আবাসন  নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথভাবে সমুন্নত পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। ‘সবার জন্য আবাসন’ সাংবিধানিক এই দায়িত্ব বাস্তবায়নের শুরুটিই হওয়া উচিত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে।

আবাসন সমস্যা সমাধানের নামে সরকারিভাবে সবধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ বিত্তশালী ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোকে স্বল্পমূল্যে প্লট বরাদ্দ—কিছু ধনী ও ক্ষমতাশালীকে আরও ধনী বানানোর ‘অপূর্ব’ একটি পদক্ষেপ মাত্র। প্রায় সব বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি জমির মালিকগণ কয়েক লাখগুণ মূল্যে ‘ব্ল্যাকে’ বিক্রি করে থাকেন Developer তথা আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে। ‘প্রত্যেকের জন্য আবাসন’ বাস্তবায়নের নামে সমগ্র দেশবাসীকে মাথাপিছু এক টুকরো জমি বা প্লট বরাদ্দ করতে গেলে (যা সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেকেরই পাওয়ার অধিকার) বঙ্গোপসাগর ভরাট করার বিকল্প আছে বলে আমার জানা নেই।

দেশে দ্রুতগতির মানবসম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি জমির স্বল্পতাকে বিবেচনায় নিয়ে জমির সুষ্ঠু ব্যবহারে সমগ্র দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি বাস্তবমুখী পরিকল্পনার আওতায় আনা ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না। ভবিষ্যতে আবাসন সমস্যা সমাধানের নামে ‘জনে জনে’ বিশেষ করে সরকার কর্তৃক জমি তথা প্লট বরাদ্দ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি, সম্প্রতি বরাদ্দকৃত সমস্ত প্লটের বরাদ্দ বাতিলপূর্বক, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ বিরাট এলাকা নিয়ে পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন আয়তনের সুউচ্চ ‘আবাসিক কমপ্লেক্স’ সরকারি ও বেসরকারি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে নির্মাণ করতে পারে।

নির্ধারিত মানসহ প্রকল্প নির্মাণপূর্বক, নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য মূল্যে নির্মিত ফ্ল্যাটসমূহ জনগণের কাছে বরাদ্দ করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ফ্ল্যাট কেনার জন্য স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে প্রায় মাসিক ভাড়ার সমপরিমাণ অর্থের কিস্তিতে, ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ সৃষ্টি করে আবাসন সমস্যা সমাধানে বিরাট অগ্রগতি আনতে পারে।

উল্লেখ্য, যে নির্মাণ সামগ্রীর সহজ প্রাপ্তির কারণে ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ ব্যয় দেশের অন্য যে কোনো স্থানের তুলনায় অনেক কম। বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লটের অবৈধ মূল্য বৃদ্ধির পরিণতিতেই প্রতি ফ্ল্যাটের মূল্য বৃদ্ধি পায় অনেক গুণ। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি কোনো এক বিকালে রমনা পার্কের কাছে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘সুগন্ধা’র উন্মুক্ত সবুজ লনে            একান্ত আলাপচারিতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের কয়েকজন নবীন স্থপতির পিঠ চাপড়ে কয়েকবার উচ্চারণ করেছিলেন—‘বাবারা শুধু ঢাকা নিয়ে পরিকল্পনা কর না, সারা দেশটারে নিয়ে পরিকল্পনা কর।’

জাতির পিতার সেই ‘সুদূরপ্রসারী উচ্চারণ’-এর প্রতি দৃষ্টিহীনের আচরণ করে ৪৬ বছর ধরে আমরা প্রায় সব কিছুই করেছি এবং প্রতিনিয়ত সব কিছুই করে চলেছি শুধু ঢাকাকে নিয়েই।

 

লেখক :   বিশিষ্ট নগর বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর