বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

শান্তি ও শিল্পবোধ

সেলিনা হোসেন

শান্তি ও শিল্পবোধ

শিল্পী হাশেম খান

শান্তি ও শিল্পবোধ পরস্পরকে সংযুক্ত করে। এটি একটি নৈতিক সম্পর্কের জায়গা। একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। শান্তির প্রার্থনা শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। এই প্রার্থনা শুধু যুদ্ধের সময়ের জন্য নয়, একটি জাতির জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্যও। শিল্পের সাধনা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অবলম্বন করেই আবর্তিত হয়। সামরিক শাসন শান্তির ধারণাকে নষ্ট করে। এই শাসনের অধীনে নাগরিকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। মানুষ বিপন্ন বোধ করে। তেমনি জরুরি অবস্থা জারি থাকলেও বলা যাবে না যে, মানুষ শান্তিতে বসবাস করছে। দেশে সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করলে গণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয়। পূর্ণ শান্তির ধারণা থেকে বিচ্যুত হয় জীবনযাপন। শিল্পের সাধকদের নামতে হয় শান্তির পুনরুদ্ধারে জীবন নির্মাণের সাধনায়।

প্রবল অশান্তির জীবনযাপন করেছেন প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দারবিশ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি সেনা আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় তার গ্রাম। শৈশবে বাস্তুভিটা থেকে বিচ্যুত হয়ে তিনি দেশান্তরী হন। স্বপ্ন ছিল স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ১৯৮৮ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি লিখেছিলেন তিনি। তাঁর কবিতা, তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও সৃজনশীল বোধ নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক। কিন্তু নিজের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তিনি দেখে যেতে পারেননি। যৌবনে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনে (পিত্রলত্ত) যোগ দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে সক্রিয় হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ৯ আগস্ট মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের ভিতর দিয়ে শেষ হয় জীবনযুদ্ধের দীর্ঘ যাত্রা। মাহমুদ দারবিশ নেই—এটাই এখনকার সত্য। তবে তিনি আছেন তাঁর জীবন-অন্বেষায় এটাও সত্য।

কয়েক বছর আগে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দ্বীপ পূর্ব তিমুরের কবি জানানা গুসামাও স্বাধীনতার জন্য তাঁর জীবন কাটিয়েছিলেন কারাগারে, লড়াইয়ের মাঠে এবং স্বরচিত কবিতার স্বপ্নের ভিতরে। তাঁর কবিতার নাম ‘আমার তিমুরের সমুদ্র’। এই কবিতার শুরুর কয়েকটি পঙিক্ত : ‘যদি আমি আমার আঙ্গুলগুলোয়/ সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাসগুলো/ আটকে রাখতে পারতাম এবং ওদের/ভাগ করে নিতে পারতাম/ শিশুদের সঙ্গে।’ সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস শিশুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অনুষঙ্গে কবি সেই শান্তির প্রার্থনা করেন, যে শান্তি শিশুর জীবনকে পূর্ণতা দেয়। একজন কবি এভাবেই শান্তির পক্ষে নির্মাণ করেছেন তাঁর পঙিক্তমালা—একই সঙ্গে নিজের সময়কে উৎসর্গ করেছেন শান্তির পথ নির্মাণে, যেখানে মাতৃভূমির স্বাধীনতাই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য।

শান্তির জন্য শিল্পীর তৃষ্ণা সর্বত্রগামী। মাহমুদ দারবিশ যখন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি লিখেন তখন শান্তির পক্ষে একটি জাতির লড়াই উচ্চকিত হয়। স্বাধীনতার জন্য লড়াই শান্তির পক্ষেই উচ্চারণ। নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতায় শিল্পীর তৃষ্ণা মেটে না, অন্য দেশ এবং অন্য জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নেও তিনি তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন— এটাই শিল্পীর ধর্ম। এখান থেকে তার ব্যত্যয় ঘটে না। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

ফরাসি সাহিত্যিক, দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র আলজিরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন বলেই বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে উঠেছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ আলজিরিয়ার পক্ষে। পরবর্তী সময়ে দ্য গল সরকার বাধ্য হয়েছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা দিতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্বপক্ষে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন সাহিত্যিক-দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। এ ট্রাইব্যুনাল ভিয়েতনামীদের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।

আগ্রাসী যুদ্ধ মানবজাতিকে নির্মূল করার যুদ্ধ, কিন্তু স্বাধীনতার যুদ্ধ শান্তির পক্ষে যুদ্ধ একটি জনগোষ্ঠীর গৌরব ও অহংকারের যুদ্ধ। যুদ্ধকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করলে শান্তির স্বরূপ অন্বেষায় শিল্পীর তৃষ্ণা কেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তা বোঝা যায়। শিল্পী তার জনগোষ্ঠীর অগ্রগামী মানুষ—যিনি জনগোষ্ঠীর স্বপ্নকে উজ্জ্বল করেন, জীবনের পক্ষে তাদের অনুপ্রাণিত করেন এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শান্তির জয়গানে মুখর হন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যশোর সীমান্তের একটি গ্রামের একজন নারী দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য নিজের ছেলেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যাকে সৈনিকরা বাড়ির আঙিনায় গুলি করে হত্যা করে। একজন মা এ কাজটি করেছিলেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়—শান্তির স্বপ্নে। এই অসাধারণ ঘটনাকে আমি আমার ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে চিত্রিত করি। লেখক হিসেবে আমার স্বপ্ন শিল্পের মাধ্যমে অনাদিকালের মানুষের জন্য জনগোষ্ঠীয় গৌরবগাথা রেখে যাওয়া। এটিও শান্তির শর্ত।

প্রখ্যাত রুশ লেখক লেভ তলস্তয় ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসে লিখে যুদ্ধের বিপরীতে শান্তিকে সমান্তরাল করেছিলেন, কিন্তু শান্তি শুধু যুদ্ধকালীন অবস্থার বিপরীতের ঘটনায় নয়। যুদ্ধ ছাড়াও অশান্ত সামাজিক পরিস্থিতি হরণ করে মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাস। অথচ শান্তির অন্বেষা জীবনের স্বাভাবিক সময়েও প্রয়োজন। যে শান্তি প্রতিমুহূর্তের, যে শান্তি পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলোকে উর্বর করবে—মানব সম্পর্কের জটিল গিট্টু শক্ত করে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করবে। মানুষ খুঁজে পাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্তের একটি সূত্র। এভাবে জীবনের প্রবাহ গতি পায়, সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়—শিল্পীর সাধনা পথের ধারে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে।

এখন শান্তির ধারণা অনেক ব্যাপক, অনেক অনুপুঙ্খ। এখন শান্তি মানে কেবল যুদ্ধ, সংঘাত বা সহিংস পরিস্থিতি না থাকা নয়। একটি দেশের মানুষ যেভাবে তাঁদের জীবনযাপন করতে চান, যে মূল্যবোধকে ধারণ করতে চান, নিজের সংস্কৃতিকে যেভাবে এগিয়ে নিতে চান, শান্তি মানে তা তাদের করতে পারার অধিকার ও সুযোগ থাকা। শান্তি মানে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। দারিদ্র্য ও অনাহার থেকে, বাসস্থান না থাকা বা নামে মাত্র থাকা থেকে, নিরক্ষরতা থেকে, স্বাস্থ্যসেবা না থাকা থেকে, নিজের মেধাকে বিকশিত করার সুযোগ না থাকা থেকে মুক্তির নামই শান্তি।

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক অমর্ত্য সেন এই একইভাবে বিশ্লেষণ করেছেন শান্তির ধারণা। তিনি তার লেখায় ভারতের বিভিন্ন পরিস্থিতিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেন অনবরত। তাঁর এই বিশ্লেষণ ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন তাদের নীতি-নির্ধারণীতে সহায়ক বলে মনে করে শান্তির পক্ষ শক্তি। তিনি বলেন, ‘ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণে ভারতের ব্যর্থতা নিদারুণ। বিশেষ বিশেষ এলাকায় চরম বুভুক্ষার পরিস্থিতি ছোট আকারে বারংবার দেখা দেয় এবং তা অনেক সময়ই নিরোধ করা হয় না। তার থেকেও বড় কথা এই যে, অর্ধহার ও অপুষ্টি গোটা দেশজুড়েই মারাত্মক রকম ব্যাপক। প্রকৃতপক্ষে, এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থা আফ্রিকার অতি দরিদ্র নিম্ন-সাহারা অঞ্চলের চেয়েও খারাপ। অপুষ্টির একটা পরিমাপ হলো ‘প্রোটিন-তেজ-পুষ্টি’। এই মাপকাঠিতে ভারতের অবস্থা আফ্রিকার থেকে দ্বিগুণ খারাপ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তার সঙ্গে এটাও দেখা যায় যে, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের অর্ধেকের বেশি রক্তাল্পতায় ভোগেন। গর্ভাবস্থায় অপুষ্টির ব্যাপকতা এবং তার ফলে অস্বাভাবিক কম ওজনের শিশুর জন্ম ও পরবর্তীকালে হৃদরোগের প্রাচুর্যও খুব (গর্ভাবস্থায় অপুষ্টির সঙ্গে পরবর্তী জীবনে হৃদরোগের যোগ ইদানীং ডাক্তারি গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে)। এসব বিষয়ে ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট।’ এই নিকৃষ্ট অবস্থা মানুষের জীবনকে শান্তি ও স্বস্তি দেয় না। তাই এই নিকৃষ্ট অবস্থার অবসানে সোচ্চার অর্থনীতি বিষয়ের লেখক অমর্ত্য সেন।

ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়ের এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো প্রসঙ্গে ‘পারমাণবিক বোমা নিয়ে যুদ্ধ খেলা’ শিরোনামে একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন, ‘কেন এখানে কোনো শান্তি আন্দোলন হচ্ছে না, পশ্চিমি সাংবাদিকরা আমাকে খোলা মনে জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু শান্তি আন্দোলন হবে কি করে যখন ভারতের সিংহ ভাগ মানুষের কাছে শান্তির অর্থ হলো নিত্যদিনের লড়াই এবং সে লড়াই খাদ্যের জন্য, পানির জন্য, আশ্রয়ের জন্য, মর্যাদার জন্য...।’ দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বড় রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান অস্থিতিশীল করে রেখেছে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর পরিস্থিতি। আতঙ্কিত মানুষরা যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কের দিকে তাকিয়ে থাকে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে। তারপরও শান্তিকামী মানুষ প্রতিবাদ করে রাজপথে মিছিল করে, মানববন্ধন করে। যদিও সন্ত্রাসের সামনে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ নেহাতই সাধারণ ব্যাপার। পাশাপাশি শান্তির জন্য সোচ্চার হয় পাকিস্তানের কবি আহমদ ফরাজের লেখনী, কিংবা ভারতের কবি প্রয়াত কাইফি আজমী বা গুলজার। তাদের ভাষা ভিন্ন, কিন্তু তাদের অনুভব এক। ওই একই লেখায় অরুদ্ধতী রায় লিখেছিলেন, সফররত প্রতিটি সাংবাদিক আমাকে শেষ যে প্রশ্নটি করে থাকেন তা হলো আরেকটা উপন্যাস লিখছেন? প্রশ্নটা আমার কাছে উপহাসের মতো শোনায়। আরেকটা উপন্যাস লিখব? ঠিক এই সময়? যখন সমস্ত সংগীত, সমস্ত শিল্পকলা, সমস্ত স্থাপত্যশিল্প, সাহিত্য তথ্য গোটা মানবসভ্যতা অর্থহীন হয়ে গেছে সেই দানব ও পিশাচদের কাছে, যাদের হাতে পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্ব? কোনো ধরনের উপন্যাস লিখব আমি? এটা একজন লেখকের ক্রোধের ভাষা, প্রতিবাদের ভাষা। শিল্পীকে তার শিল্প মাধ্যমে কাজ করতে হবে। তাকে তা ধ্বংসযজ্ঞে নিমজ্জিত মানুষের জন্য জীবনের গান গাইতেই হবে।

গ্রিক মিথলজিতে মানুষের জন্য আগুন চুরি করেছিলেন প্রমিথিউস। এই অপরাধে দেবতা জিউস তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। পাহাড়ের উপরে নির্জন সমুদ্রের ধারে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকে। প্রতিদিন একটি ঈগল এসে খুবলে খেত তার হৃৎপিণ্ড। তাতে বিচলিত ছিলেন না প্রমিথিউস। যে আগুন তিনি মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিলেন, সেটি ছিল শান্তির আগুন। মানুষ আগুনকে বেঁচে থাকার পক্ষে ব্যবহার করেছিল। এই একই আগুন আবার বিধ্বংসী হয় দানবের হাতে। ওই বিধ্বংসী আগুনের বিপরীতে শান্তির প্রতীক ‘কপোত’ এঁকে ছিলেন বিশ্বনন্দিত শিল্পী পাবলো পিকাসো। যুদ্ধের পটভূমিতে অঙ্কিত ‘গয়েরনিকা’ তাঁর অমর শিল্পকর্ম।

পাবলো পিকাসো একটি গর্ভবতী ছাগলের লোহার ভাস্কর্য তৈরি করে বলেছেন, জীবনের শেষ নেই—আমাদের নতুন জন্মের প্রত্যাশায় থাকতেই হয়। তাই মালয়েশিয়ার কবি সিসিল রাজেন্দ্র, ইন্দোনেশিয়ার ঔপন্যাসিক প্রমোদিয়া অনন্ত তুর বা মুখতার লুবিস, ত্রিনিদাদের লেখক ভি এস নাইপল, শ্রীলঙ্কার ঔপন্যাসিক রমেশ গুনেস্কার কিংবা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ল্যাটিন আমেরিকার লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং আরও অসংখ্য লেখক মারণাস্ত্রময় সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিপন্ন মানবজাতির পক্ষে প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করছেন।

সাম্প্রাতিককালে মানবসভ্যতার ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে ইরাকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে। ইরাকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা চলছিল বারো বছরের উপর ধরে, আর কিউবায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চলছে চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে। ইরাকে ও কিউবায় নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ লেখক এলিস ওয়াকার নিজ দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে চিঠি লিখেছিলেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অপুষ্টি ও অনাহারে সেসব দেশের শিশুদের মৃত্যুর কথা। যুদ্ধের সময়ে ইরাকি শিশুরা উপর থেকে ভেসে আসা হলুদ রঙের প্যাকেটকে খাদ্য ভেবে ছুটে আনতে গিয়ে মারণঘাতি ক্লাসটার বোমায় প্রাণ হারিয়েছে। ২০০৩ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে টোকিওতে অনুষ্ঠিত চার দিনের বইমেলায় এলিস ওয়াকার এসেছিলেন। বর্ণবৈষম্যের অবসান ও জেন্ডার সমতা আদায়ের লক্ষ্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরীর জীবন সংগ্রামকে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। শান্তির পক্ষে এর চেয়ে কাজ কোনো শিল্পীর আছে কি না আমরা জানি না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুশয্যায়। তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও প্রতিনিয়ত জানতে চাইতেন ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতির খবর। যেদিন সোভিয়েত বাহিনী পিছু হটত সেদিন তার মন খারাপ থাকত বলে তার জীবনীকার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখেছেন। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার বিজয় তিনি দেখে যেতে চেয়েছিলেন। আজীবন লিখেছেন শান্তির পক্ষে। শান্তির পক্ষে তাঁর অবিনাশী পঙিক্তমালা মানবজাতির সম্পদ। বাঙালির অহংকার।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের পক্ষে, শান্তির পক্ষে নিবেদিত-প্রাণ কবি ছিলেন। জেল খেটেছেন, কিন্তু কোথাও আপস করেননি। অরুদ্ধতি রায় যেটাকে ভারতীয়দের মর্যাদার জন্য লড়াই বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম গত শতাব্দীর বিশের দশকে এ লড়াইকে উচ্চারণ করেছেন ‘বল বীর বল চির উন্নত মম শির’ বলে—তফাৎ প্রকাশের, তফাৎ শিল্পের মাধ্যমের শিল্পীর অনুভবের ধারাবাহিকতা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জীবনে এভাবে টিকে আছে। শুভবোধের ধারণা থেকে এ অঞ্চলের শিল্পীরা কখনো বিচ্যুত হয়নি। প্রশ্ন হলো ক্ষমতায় যাঁরা যান, সেই রাজনীতিবিদরা কি শিল্পীর আশার বাণী শোনেন? তাদের কাছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’

এখন প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র, সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক, সিনেমা, সংগীত ইত্যাদি সৃজনশীল কাজে অনবরত নির্মাণ করে যাচ্ছে আপন শিল্পভুবন। তারপরও শান্তির জন্য শিল্পীর আশঙ্কা ফুরোয় না। মানবাধিকারহীন বর্তমান বাংলাদেশে মানুষের সবচেয়ে বড় সংকট জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা—প্রতিনিয়ত বিঘ্নিত হয় মানুষের স্বস্তি। তবুও এই সময়কে পরাভূত করে শান্তির পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার আশাব্যঞ্জক প্রত্যাশা ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছে শিল্পীদের স্ব-স্ব প্রকাশ মাধ্যমে। শিল্প একটি মাধ্যম, সৃজনশীলতা সেই মাধ্যমকে পূর্ণতা দেয়। কোনো সৃজনশীল মানুষই জীবনের বিরুদ্ধাচারণ করে না। কারণ শিল্পের সবচেয়ে বড় উপাদান মানুষ এবং তার বহমান জীবন। শান্তি এই জীবনকে অর্থবহ করে, মর্যাদাশীল করে এবং মহত্বের অঙ্গীকারের পথে পরিচালিত করে। তাই নান্দনিক বোধে পুষ্ট জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত শান্তি। মানুষ দরিদ্র হতে পারে, অভাবে দিনযাপন করতে পারে কিন্তু তার মানবিকবোধকে হারাতে পারে না। যদি হারায় তাহলে তার সবচেয়ে বড় সম্পদ বিলুপ্ত হবে, বিলুপ্ত হবে শান্তির পক্ষে সৃজনশীল মানুষের অবিনাশী শিল্পকর্ম।

এমন ঘোর অন্ধকার পৃথিবীকে গ্রাস করবে এই মূঢ় ধারণা চিন্তা করাও অকল্পনীয়, সৃজনশীল মানুষের পক্ষে তো নয়ই। যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সামরিক শাসন, যৌথবাহিনীর হাতে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, স্বৈরশাসনের অরাজকতায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমাননা, নাগরিক অধিকারের অমর্যাদা এবং সবার উপরে পারমাণবিক বোমার দিকে দুচোখ মেলে তাকিয়ে জেগে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার শিশুর জন্য আছে অভয় বাণী : আমার হলো সারা, তোমার হলো শুরু।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর