শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রজাতি-মানুষ আর ব্যক্তি-মানুষের পরিচয়

মুহাম্মদ ইব্রাহীম

প্রজাতি-মানুষ আর ব্যক্তি-মানুষের পরিচয়

সর্বশেষ দুটি বই আমি কেন লিখেছি, কী নিয়ে লিখেছি এ সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হয়েছে আমাকে। আমিও দেখলাম দুটি বইয়ের মধ্যে বহিরঙ্গে না হলেও অন্তরঙ্গে একটি ধারাবাহিকতা হয়েছে। সেদিকটা নিয়েই আজকের এই লেখা। ২০১৭ সালে আমার যে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল তার নাম ‘মানুষের পায়ের আওয়াজ’। আর এ বছর যেটি হয়েছে তার নাম ‘আমি কে’। বই দুটি প্রকাশ করেছে ‘অনন্যা’; দুটিই বেশ বড় কলেবরের বই। দুই বইয়েরই বিষয়বস্তু মানুষ— প্রথমটি প্রজাতি-মানুষ, দ্বিতীয়টি ব্যক্তি-মানুষ। আপন সত্তার গঠনের প্রতি এবং নিজের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বসূরিদের প্রতি একটি স্বাভাবিক কৌতূহলই বই দুটি লেখার পেছনে প্রেরণা। তবে এর পেছনে আমার একটি লোভও কাজ করেছে। খুব সাম্প্রতিক সময়ে মানুষকে উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান প্রবলভাবে কার্যকর হয়েছে, যার ফলে বহুদিনের প্রচলিত মানববিদ্যায় এই প্রথম সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দরজাটা বেশ খানিকটা খুলে যেতে পেরেছে। পাঠককে সঙ্গে নিয়ে এই খুলে যাওয়া দরজাটির ফাঁকে উঁকি মেরে দেখাটাই সেই লোভ। প্রথম বইটিতে বিজ্ঞানের সেই উন্মোচনটি সামনে এনেছি প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবন সম্পর্কে আমরা আগে যা শুধু অনুমান করতে পারতাম এখন বিজ্ঞান তাকে অনেকাংশে জাজ্বল্যমান করে তুলতে পেরেছে। আর মানুষের আত্মপরিচয়ের যে দরজা বিজ্ঞান অতিসম্প্রতি খুলতে পেরেছে তাতে আমরা সে পরিচয় ডিএনএর ভাষায় একরকম লেখাজোকাভাবে দেখতে পারছি। দ্বিতীয় বইটিতে সেটি দেখার চেষ্টা রয়েছে।

মানুষের পায়ের আওয়াজে আমার আগ্রহটি হলো এক একজন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবনকে দেখার চেষ্টা করা— শুধু তার পারিপার্শ্বিকতার বর্ণনা থেকে নয়, একেবারে মানুষগুলোর মন-মানসিকতার ভিতর গিয়ে। এটি অন্তরঙ্গভাবে করার সুবিধার জন্য গল্পের আঙ্গিক ব্যবহার করেছি, যেটি আমার জন্য ছিল একটি নতুন প্রচেষ্টা। নানা যুগের এবং পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষের জীবনে বসত, জীবিকা, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে একটি মূল সুর আছে বটে কিন্তু সময়ে সময়ে বিশেষ বিশেষ স্থানে জীবনভঙ্গিতে নতুনত্বের স্ফুরণও লক্ষ্য করা গেছে। এই উভয় প্রকারকে এসব গল্পে আনার চেষ্টা করেছি হাজার হাজার বছরের গতানুগতিক জীবনের সঙ্গে ওই ব্যতিক্রমী মাত্রাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। সেজন্যই প্রত্যেকটিতে একটি মূল চরিত্র সৃষ্টি করেছি যার জীবনের কথা, ভাবনা-চিন্তা, এবং আনন্দ-বেদনাই হয়েছে গল্পের উপজীব্য— সবই বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। মানব-মস্তিষ্ক নিয়ে বিজ্ঞানীদের একটি আবিষ্কার কাজটিকে কিছুটা সহজ করেছে। এর মতে আজ থেকে ৭০-৮০ হাজার বছর আগেই মানুষের মস্তিষ্ক আজকের পূর্ণতায় পৌঁছে গিয়েছিল। কাজেই আজকের মানুষের যে আবেগ-অনুভূতি অতীতের অন্তত এর পরের সকল মানুষের অনুভূতিগুলো তার থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। সুখ-দুঃখের নানা পরিস্থিতিতে তাদের আচরণ তাই সহজে ধরে নিতে পেরেছি।

আসলে ওই ৭০-৮০ হাজার বছর আগের দিনগুলোতেই মানুষের কালচার ও শিল্পবোধও যে পাখা মেলেছিল তার একটি নমুনা দেখলাম দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লোম্বোস গুহায় পাওয়া ওসময়ের কিছু নিদর্শন থেকে। বেশ বড়সড় একটি শঙ্খের আধ-খোলকের মধ্যে রঙের গুঁড়ো তেলে মিশিয়ে প্রসাধনসামগ্রী তৈরির উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট অনেক শামুকের ঠিক একই জায়গায় এফোঁড়-ওফোঁড় ছিদ্র করা যাতে স্পষ্ট বোঝা যায় এটি কোনো রমণীর গলার মালা হিসেবে গাঁথা হয়েছিল। এখান থেকেই স্পষ্ট খুঁজে পেয়েছি তরুণী সাজুনি ও তার পরিবারকে; সাজুনির মন-মানসিকতা, স্বাদ-আহ্লাদকে। তা ছাড়া নিকটবর্তী সমুদ্রসৈকতে যে বহু মানুষের সাময়িক সমাবেশ ঘটত তার নিদর্শন থেকে আমরা সেখানে একটি বসন্ত মেলার আভাস পাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার দলে যাদের যাযাবর জীবন কাটে তাদের জন্য এমন সমাবেশ মাঝে মাঝে খুব দরকার ছিল— বিনোদন, জীবনসঙ্গীর খোঁজ, পণ্যবিনিময় ইত্যাদির কারণে। কাজেই সাজুনিদের সেবারের প্রসাধনী আয়োজন যে কিছুটা মেলামুখী ছিল তা তো কল্পনা করাই যায়।

লাখ লাখ বছরের প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের প্রায় সব দলই ওরকম যাযাবর শিকারি-সংগ্রাহকের ছোট দল ছিল— দশ-বারো জনের পারিবারিক দলই বেশি। কিন্তু এখন থেকে ৮-১০ হাজার বছর আগের সময় থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অন্তত কিছু কিছু জায়গায় দেখি ইট-পাথরের বিশাল সব নগরীতে নানা ধরনের কর্মব্যস্ততায় হাজারো মানুষের একত্র আবাস। তারই একটির অপূর্ব সব নিদর্শন থেকে আমি গল্পের প্লট পেয়ে গেছি ইরাকের উরুকের কেরানির; সিল মেরে রোদে শুকানো কাদার ছোট ছোট টোকেন দিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া ছিল যার একটি কাজ। ওভাবেই সাক্ষাৎ পেয়েছি মেক্সিকোর সান লোরেনজোর গুরুর যিনি সেখানকার বিশালাকার পাথরের ভাস্কর্য গড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ ভাস্করদের তালিমও দেন। জানতে পারি এই নগরীর কাছেই জলায় ঘেরা গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারের মামুলি ছেলেটির নগরীতে এসে ধীরে ধীরে গুরু হয়ে ওঠার কাহিনী। তাদের গড়া মানুষের মাথার প্রকাণ্ড মূর্তির এবং সেই সঙ্গে অন্য কিছু কাল্পনিক চেহারার মূর্তির যে অভিব্যক্তি তাতেই সন্ধান পাই এখনকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ভয়, সংস্কার আর গর্বের একরকম পরিচয়।

গল্প খাড়া করতে গিয়ে আমি তার মালমসলা খুঁজেছি ওই মানুষগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের মধ্যে। আর বিজ্ঞানী সেই আবিষ্কারগুলো খুঁজেছেন অদ্ভুত কৌশলের সব গবেষণার মধ্যে। যেমন এর খোঁজ করতে গিয়ে আমি পেলাম পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অসংখ্য হাড়ের টুকরার বিশ্লেষণ— পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়েছে  কোন হাড়গুলো কোন পশুর, তার কোন অংশের, কোন বয়সের, বন্য না গৃহপালিত, সেটি কি চিবোনো হাড়, একি রান্না করা বা ঝলসানো হাড়, কোনটির সংখ্যাতাত্ত্বিক আধিক্য কত ইত্যাদি তালিকার পর তালিকা। বিজ্ঞানীর কাজগুলো প্রায়ই খুব সূক্ষ্ম, অণুবীক্ষণ, রাসায়নিক পরীক্ষা, ডিএনএ পরীক্ষা, কিছুই বাদ যায় না। এসব থেকে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানী টেনেছেন। এসব সিদ্ধান্ত থেকেই গল্পকে বের করে আনতে হয়েছে। অনেক সময় কাজটি বেশ সহজ— গল্পের প্লট যেন আপনিই ধরা দিয়েছে; অনেক সময় তা হয়নি। এমনিতেই মানুষের জীবন নিয়ে গল্প বলায় আনন্দ আছে— সেজন্যই তো যুগে যুগে সবাই গল্প ভালোবেসেছে। কিন্তু ডিটেকটিভের মতো খুব সামান্য থেকে যে জীবনকে উদ্ঘাটন করতে হয়েছে, তার গল্প লেখার একটি আলাদা আনন্দ আছে বৈকি। মানুষের পায়ের আওয়াজের আনন্দটি সেরকমের।

যেসব জায়গায় আমরা সাধারণ দর্শক কিছুই দেখতে বা বুঝতে পারি না বৈজ্ঞানিক প্রত্নতত্ত্ববিদ এখন সেখানকারও সব কাহিনী উদ্ঘাটন করতে পারছেন— তার চমৎকারিত্ব আরও দুর্দান্ত। এভাবে আবিষ্কৃত অনেক জনপদ, প্রাগৈতিহাসিক যাযাবরের অস্থায়ী ক্যাম্প, তাদের হাসি-কান্নার অনেক স্থান আগে দেখে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। ওখানটায় যে ভালো করে দেখতে হবে, খনন করতে হবে তাও বা কীভাবে বুঝব— এ তো ঘন বন মাত্র, অথবা একটানা ধূধূ মরুভূমি। অথচ এখানেই বিমান থেকে লেজার আলোর প্রতিফলনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে মেক্সিকোর জঙ্গলের তলায় রমরমা নগরী সান লোরেনজো যেখানে ছিল আমাদের গুরু; অথবা চৌম্বক জরিপে ধূধূ সাহারার বুকে ধরা পড়েছে বহু হাজার বছর আগের সমৃদ্ধ জলা আর তৃণভূমি যেখানে গোবেরোতে আমাদের রাখাল শখানেক গরুর পাল নিয়ে এদিক থেকে ওদিকে যেত। চৌম্বক জরিপ বলে দিয়েছে বালির একটু নিচে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে তার সব সাক্ষ্য-প্রমাণ— বোঝা যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন কেমন সবুজ জায়গাকে এখন মরুতে পরিণত করেছে।

শুধু আবাস খুঁজে পেলেই তো গল্প সম্পূর্ণ হয় না। অবশেষে সব কাজ সেরে পরিবারের সবাই যখন উনুনের চারপাশে বসেছে গিন্নি এখন কী খেতে দিয়েছিল তাদের? সেই হাঁড়ির খবরটি বিজ্ঞানীকে নিতে হয়েছে হয়তো হাঁড়ির কয়েকটি ভাঙা টুকরো থেকে। রান্নার সময় হাঁড়ির অতি সূক্ষ্ম রন্ধ্রগুলোয় খাবারের যা ঢুকেছিল তার অণুগুলো পর্যন্ত এখন অবিকৃত নেই। কিন্তু ম্যাস-স্পেকট্রোস্কোপির মতো জটিল বৈজ্ঞানিক কৌশলে তার পরও মেলে নানা খাবারের কিছু কেমিক্যাল চিহ্ন। সেখান থেকে উদ্ঘাটন হয় খাবারের; সেখান থেকে শিকারের, চাষবাসের। পাশাপাশি নানা বেশ কটা উনুনে একটি মাত্র পশুর অঙ্গার হওয়া হাড় মিলছে অথচ সে পশুটি দু-এক জন মানুষই শিকার করতে পারে— তাহলে বুঝতে হয় ওরা আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীকে না বিলিয়ে কোনো কিছু খেত না— সমাজটাই ছিল সহযোগিতার ভিত্তিতে।

আরও সুদূর অতীতে আদি প্রজাতির মানুষের কথায় চলে গেলে গল্পের কাজ কঠিন হয়ে যায়। এমনকি এসব আনন্দ-বেদনা, অতীত-ভবিষ্যতের চিন্তা করার মতো মস্তিষ্ক-মনন তাদের আদৌ ছিল কিনা সন্দেহ। কিন্তু সেখানেও বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য গল্পের সহায়ক হয়েছে। তাই আমরা ইরেকটাস প্রজাতির মানুষ নারিকোটমের বালকের অকালমৃত্যুতে তার মা স্বাভাবিক শোক অনুভব করতে পেরেছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত না হলেও, ওই ইরেকটাস প্রজাতির একটি পরিবারে (প্রায় ২০ লাখ বছর আগে) গুরুতর অসুস্থ নড়তে চড়তে সম্পূর্ণ অক্ষম বৃদ্ধাকে খাইয়ে পরিয়ে সেবা করে কয়েক মাস যে বাঁচিয়ে রেখেছিল ফসিল থেকে অসুখের প্রকৃতি ও পরিস্থিতি নির্ণয় করে তা আমরা বুঝতে পারি। তেমনি আমাদের মতো সেপিয়েন্স প্রজাতির তরুণী-তন্বী যে প্রতিবেশী ভিন্ন প্রজাতির নিয়ানডার্থাল যুবক বাসুর প্রেমে পড়েছিল তা আমরা কল্পনা করতে পারি সেদিনের সেপিয়েন্স হাড়ের ডিএনএতে নিয়ানডার্থাল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জিনের উপস্থিতির খোঁজ পেয়ে। এই জিন এখনো ইউরোপীয় মানুষের মধ্যে দেখা যায়।

পায়ের আওয়াজের চরিত্রগুলোকে ব্যক্তি-মানুষ হিসেবেই দেখেছি। তবুও সেখানে প্রধান লক্ষ্য ছিল মানুষের অগ্রগতির ধারাবাহিকতার প্রতিই— প্রজাতি-মানুষের অগ্রগতি। ‘আমি কে’ বইটিতে ব্যক্তি-মানুষের পরিচয় পেতে চেয়েছি একেবারে তার কোষে কোষে ঢুকে— সেখানে ডিএনএর ভাষায় তার যে পরিচয় লেখা আছে তার অতিসাম্প্রতিক উদ্ঘাটনগুলোর সুযোগ নিয়ে। বিজ্ঞান যে এই অভাবনীয় কাজটি করতে পেরেছে পাঠককে তার স্বাদ দেওয়াটাই হচ্ছে এই বইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য। কাজটি যে দুর্দান্ত তার কারণ হলো এই সেদিন পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানী আমাদের বুঝিয়েছেন আমার পারিপার্শ্বিকতাই ঠিক করে দিয়েছে আমি কে। এই পারিপার্শ্বিকতা মানে আমাদের কালচার, লালন-পালন, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছু। যেমন কারও মধ্যে যদি বিশেষ ব্যক্তিত্ব-বৈকল্য দেখি তার জন্য দায়ী করা হয়েছে ছোটবেলায় মায়ের অযত্ন, বাবার অত্যাচার, শারীরিক মানসিক নির্যাতন ইত্যাদির মতো জিনিসকে; তার নিজের জীবসত্তার কোনো খবর নেওয়াকে খুব জরুরি মনে হয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিত্ব, স্বভাব, আচরণ, সক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুই নবজাতক শিশু সঙ্গেই নিয়ে আসে ডিএনএর মাধ্যমে পূর্বপুরুষ থেকে— দীর্ঘ বিবর্তনে যা সৃষ্টি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত একই সব পূর্বপুরুষ থেকেও এলেও অনেকটা লটারির মতো দৈবচয়নে তাতে নানা জনে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। হ্যাঁ, পারিপার্শ্বিকতাও কিছু অবদান রাখে তবে তাও ওই ডিএনএর প্রকাশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। আর তার অধিকাংশ ঘটে শৈশবে ও মায়ের গর্ভে, তাও যদি পারিপার্শ্বকতার নেতিবাচক দিকগুলো চরমে পৌঁছে যায় তবে।

আগের সেই ধারণাগুলো ঠিক বৈজ্ঞানিক ছিল না। কিন্তু এখনই সম্ভব হয়েছে অন্য নানা সুসংগঠিত বিজ্ঞানের মতো আধুনিক ডিএনএ বিজ্ঞানের পক্ষে (অণুজীববিজ্ঞান) গাণিতিক ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষণের কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়া ফলাফল দেওয়ার সাফল্য। আমি কে বইটিতে এই বিরাট পরিবর্তনটি পাঠকের কাছে খোলাসা করার আশায় তার জন্য ডিএনএর ও বিবর্তনের একটি দ্রুত সহজ পাঠেরও ব্যবস্থা করেছি। কেমন করে লেখা থাকে ডিএনএর ভাষার বার্তাগুলো? ওই বার্তাগুলোর মধ্যে যে নির্দেশ তা প্রতিপালিতই বা হয় কেমন করে? দেখাবার চেষ্টা করেছি কীভাবে বিজ্ঞানীরা সরল বার্তার ক্ষেত্রে এসব বুঝতে পারা শুরু করে অবশেষে মনমানসিকতা গঠনের জটিল বার্তাকেও বুঝতে পেরেছেন।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত তার জীবসত্তার অর্থাৎ ডিএনএর প্রকাশ ব্যক্তি-মানুষের ক্ষেত্রে যেভাবে ঘটে তাতে পারিপার্শ্বিকতার একটি হাত থাকে। ডিএনএকে যদি আমার ‘ভিতর’ বলি আর পারিপার্শ্বিকতাকে যদি ‘বাহির’ বলি তবে জন্মগত প্রবণতার প্রকাশটি ঘটে উভয়ের পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে— সেজন্যই এই আলোচনার অধ্যায়টির শিরোনাম দিয়েছি কবি চণ্ডীদাসের অনুসরণে ‘ঘর কৈঁলু বাহির বাহির কৈঁলু ঘর’। এ ব্যাপারটিও এখন আর কোনো আপ্তবাক্য মাত্র নয়, বরং তার রাসায়নিক বিক্রিয়াসহ এর পুরো ঘটনাটি কঠিন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত। তাই আমার প্রতিটি কোষে থাকা ডিএনএ-সমগ্রের পাঠটি আমার আত্মপরিচয়ের ভিত্তিটি দিয়ে দিতে পারে। যেসব জন্মগত ব্যক্তি-প্রবণতা আমি ধারণ করছি বিশেষ পারিপার্শ্বিকতা সে প্রবণতার প্রকাশকে এদিক-ওদিক মোড়ও নেওয়াতে পারে। দুটি দিকের কোনোটিকেই অবহেলা করার জো নেই। আমি আনন্দিত যে আমার মনোজগৎ এখন আর বিজ্ঞানের কাছে দুর্ভেদ্য দুর্গটি নেই। বাকি সব রহস্যের মতো এটিও বিজ্ঞানের আওতায় এসেছে। আমি কে বইটি এ আনন্দেরই একটি প্রকাশ।

‘মানুষের পায়ের আওয়াজ’ আর ‘আমি কে’ উভয় বইয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাজুয্যও রয়েছে— যেই অর্থে প্রজাতি-মানুষের ধারাবাহিকতাতেই ব্যক্তি-মানুষ এসেছে সেই অর্থে। মানুষের প্রবণতাগুলোর মধ্যে চিরকালই নানা কিছুর মিশ্রণ ছিল— যেমন প্রতিযোগিতা ছিল তেমন সহযোগিতাও ছিল, যেমন সহিংসতা ছিল তেমন সহমর্মিতাও ছিল। এই মিশ্রণ এখনো রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ওপর, বৈজ্ঞানিক চিন্তার ওপর ভরসা রাখতে পারলে আজকের মানুষের মধ্যে আরও গভীর বিশ্ব-সমঝোতা ওই চিরায়ত মিশ্র ধারাকে ক্রমে শান্তির, সৌহার্দ্যের ও টেকসই পৃথিবীর লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হয়তো পারবে।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর