শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমার জীবনে মিডিয়ার ভূমিকা

তসলিমা নাসরিন

আমার জীবনে মিডিয়ার ভূমিকা

মিডিয়াকে দেখছি ’৭৩ সাল থেকে। আমি তখন ইস্কুলে পড়ি। চিত্রালী তখন শিল্পী-সাহিত্যিকদের পত্রিকা। ওখানেই সাবিনা আর রুনার গান সম্পর্কে আমার মন্তব্য ছাপা হয়। ওটিই কোনও জাতীয় পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর থেকে আমার ঠিকানায় শত শত চিঠি আসে। শুধু তাই নয়, ওই লেখাটির পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর লেখা ছাপা হতে থাকে। পুরো ব্যাপারটা আমাকে কী রকম যেন বিখ্যাত বানিয়ে দেয়। ইস্কুলে যাওয়া আসার পথে টের পাই, শহরের প্রায় সকল শিক্ষিতই জানে যে আমার লেখা চিত্রালীতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। চিত্রালী পড়তো আমার বড় ভাই। কিনেও আনতো বাড়িতে। পূর্বাণীও কিনতো। সিনেমা নামেও একটি পত্রিকা ছিল। বই পোকা যেমন ছিলাম, সিনেমার পোকাও ছিলাম। মাঝে মাঝেই আমি ওসবে সিনেমা নিয়ে লিখতাম। এরপর এলো বিচিত্রার যুগ, সেখানেও চললো লেখা। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নামে একটি বিভাগ চালু করেছিল বিচিত্রা, দু’তিন টাকায় যা খুশি তাই লেখা যেত। আমার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনগুলোও দেখলাম ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব কিশোরী বয়সের আনন্দ, আগ্রহ ধীরে ধীরে অন্যদিকে মোড় নিল। বিচিত্রা থেকে চিঠি এলো, আমি যেন লেখা বন্ধ না করি। চিত্রালী, পূর্বাণী সিনেমা পড়া বন্ধ করে আমি নতুন বের হওয়া ম্যাগাজিন সন্ধানী, রোববার পড়তে শুরু করি। আমার কবিতা তখন শহরের, মায় গোটা দেশের, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা পত্রিকাগুলোয় ছাপা হতো। নিজেও ১৯৭৮ সাল থেকে একটি কবিতা পত্রিকা ছাপাতে শুরু করি। মেডিকেলে পড়াশোনার কারণে কিছু কাল পত্রিকা ছাপানো বন্ধ রাখতে হয়েছিল।

আশির দশকের মাঝামাঝি আমার কবিতার বই বের হয়। এক সময় কবিতার বইগুলো এত জনপ্রিয় হয় যে দেশের নতুন ধরনের রাজনৈতিক সামাজিক বিষয় আশয় নিয়ে ছাপানো ম্যাগাজিনগুলোয় আমাকে নিয়মিত লিখতে বলা হয়। আগেও মেয়েদের স্বাধীনতার পক্ষে কবিতা লিখেছি, এবার লিখতে হচ্ছে কলাম। খবরের কাগজ, আজকের কাগজ, পূর্বাভাস, যায় যায় দিন, সমীক্ষণ এসব পত্রিকায় লিখতাম। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই মূলত লিখতাম। আমার লেখাগুলো তখন মানুষ পড়তোও খুব। বিতর্ক হতো লেখা নিয়ে। মেয়েদের চিঠি আসতো প্রচুর, মেয়েরা বলতো, আমার লেখা তাদের ভালো লাগছে, এ তাদের জীবনের গল্পই। আমি তখন ব্যস্ত মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি নিয়ে। ফাঁকে ফাঁকে কলাম লিখি। এই কলামগুলো জড়ো করে বই বের হলো, সেই বই আনন্দ পুরস্কার পেল।

মিডিয়া যেমন আমাকে আমার মত, যে মত লক্ষ মানুষের মতের চেয়ে ভিন্ন, প্রকাশ করতে দিয়েছে। মিডিয়া তেমন আমার বিরুদ্ধেও মিথ্যে কথা লিখে আমার পাঠকপ্রিয়তা নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের মৌলবাদী পত্রিকাগুলো, নারীবিদ্বেষী সম্পাদককুল আমার শত্রুতা করতে দীর্ঘকাল ব্যস্ত ছিল। এমনকি প্রগতির পক্ষের পত্রিকা বলে যেগুলোকে চিনতাম, সেগুলোর কেউ কেউ শুধু পত্রিকা বিক্রির জন্য হলুদ সাংবাদিকতা করেছে। যেমন রোববার। রোববারে সম্ভবত কলাম লেখার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম বলে আমার বিরুদ্ধে পুরো একটি সংখ্যাই ওরা ছাপায়। দ্বিতীয় তৃতীয় মুদ্রণও করতে হয়েছিল ওদের। সাপ্তাহিক ২০০০ ছাপালো আমার মিথ্যে ইন্টারভিউ। কী ভয়ঙ্কর! ওদের কীর্তির কথা যে মানুষকে জানাবো, তার উপায় ছিল না। আমি তখন নির্বাসনে। নির্বাসন জীবনে আমার কলাম ছাপানো বন্ধ করে দেয় সবকটি পত্রিকা। আমি যে সাপ্তাহিক ২০০০-এর মিথ্যেচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো, সেই প্লাটফর্মও আমার ছিল না।

আমার পক্ষে লিখলেও কাগজ বিক্রি হতো ভালো, কিন্তু বিপক্ষে লিখে অসৎ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বাড়াতে চাইতো। স্বাধীনচেতা নারীবাদীকে শাস্তি দেওয়াও হলো, টাকাও কামানো হলো। ইনকিলাব, সংগ্রাম, মানবজমিন, সুগন্ধা, আজকের সূর্যোদয়, ইত্যাদি পত্রিকার কাজই ছিল আমার সম্পর্কে মিথ্যেচার করা। একবার ‘রোববার’ আমার বিরুদ্ধে লিখেছিল। তারা কলাম লেখার আহ্বান জানিয়েছিল, আমি রাজি হইনি, এরকম কোনও কারণ। চরিত্রহনন করে প্রতিশোধ নিয়েছিল। যেহেতু আমি মামলা করিনি কোনও পত্রিকার বিরুদ্ধে, তাই খুব সহজ ছিল আমার বিরুদ্ধে যা নয় তা বলা। মিডিয়া ভালো, মিডিয়া আবার খারাপও। মিডিয়ার কারণে আমি লক্ষ লক্ষ মেয়ের দুঃখের কথা বলতে পেরেছি। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। মিডিয়ার কারণেই আবার আমি একঘরে হয়েছি, মিডিয়াই আমার লেখা বন্ধ করে আমাকে অস্পৃশ্য করেছে। মিডিয়ার কারণে মানুষের ঘৃণা আর বিদ্বেষও জুটেছে অনেক। মিডিয়া ভীষণ শক্তিশালী। একবার আমার বাবা সুগন্ধা নামের ম্যাগাজিনে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা পড়ে আমাকে ঢাকা থেকে টেনে ময়মনসিংহে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে বন্দি করেছিলেন। কত বলেছি, ওই ম্যাগাজিন মিথ্যে লিখেছে, বাবা বিশ্বাস করেননি। কারণ ছাপার অক্ষরে যা লেখা হয় তা তিনি বিশ্বাস করতেন, মুখের কথায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। আমার বাবার মতো অনেকে এখনো আছে, পৃথিবী কচ্ছপের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে, এটি ছাপার অক্ষরে দেখলে বিশ্বাস করবে পৃথিবী কচ্ছপের পিঠেই দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তি তাদের একটাই, ছাপা হয়েছে। ছাপা হলেই হলো, তলিয়ে কিছু দেখতে চাইবে না ঘটনা সত্য কিনা, কোনও প্রমাণ চাইবে না, শুধু বিশ্বাস করবে।

মিডিয়াকে অবজ্ঞা করেছি জীবনভর, বিশেষ করে যখন সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছে। বিশেষ করে টেলিভিশনের জন্য, এর একটিই কারণ, আমি ভালো বক্তা নই। কখনো কখনো ইচ্ছে হয়নি দুনিয়ার হাজার রকম বিষয় নিয়ে কথা বলতে। ইউরোপের নির্বাসন জীবনে দেখেছি মিডিয়াকে এড়াতে চাইলেও আমার ইউরোপীয় প্রকাশকরা মিডিয়াকে আঁকড়ে ধরেন। বই বিক্রি করতে চান বলে মিডিয়াকে দরকার তাঁদের, আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য মিডিয়া লাইন দিচ্ছে, খুশি হচ্ছে প্রকাশক। বাধ্য হয়েছি ইন্টারভিউ দিতে। যখন প্রকাশকের বই বিক্রির ধান্ধা নেই, বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরার প্রস্তাব হামেশাই প্রত্যাখ্যান করেছি।

একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, মিডিয়া যখন আমার লেখা ছাপায়, তখন লোকে বলে আমি ‘অ্যাটেনশন সিকার’, আর যখন কিছু ছাপায় না, তখন বলে আমি ফুরিয়ে গেছি। মন্দ কিছু একটা বলবেই। আমি যদি লোকে যা ইচ্ছে তাই বলুক, আমার পথে আমি চলবো, আমি যা বিশ্বাস করি, তা আমি বলে যাবো বা লিখে যাবো— এই সিদ্ধান্ত না নিতাম, তবে শুরুতেই লেখক-আমার মৃত্যু হতো। আমি হারিয়ে যেতাম দুর্মুখদের ভয়ে।

আমার সবচেয়ে বিস্ময় জাগে, একজন জনপ্রিয় কলাম-লেখক ছিলাম আমি আর মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিয়ে আমাকে নির্বাসনে পাঠালো সরকার, এ সরকারের দোষ, কিন্তু কী করে সেসব পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকরা দিব্যি মুছে ফেললেন আমার নাম, যেসব পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখতাম? কেউ আমার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ করেননি। সরকারের বা মৌলবাদীদের ভয়েই হয়তো আমার লেখা আর ছাপাননি। জানি না অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে।

ইউরোপ আমেরিকার পত্রিকায় মাঝে মাঝে লিখতাম। নিউইয়র্ক টাইমস, ল্য মন্দ— এরকম সব বড় পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে, কিন্তু বাংলায় লেখার যে আনন্দ, আর নিজের দেশে নিজের ভাষায় লেখার যে উত্তেজনা, সেটি পাইনি। ইউরোপ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের কাগজে প্রায়ই লিখতাম, আনন্দবাজারে, প্রতিদিনে, স্টেটসম্যানে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশের মতো ঘটনা ঘটলো, কেউ আর আমার কাছে লেখা চাইলো না ছাপানোর জন্য। সরকারের আর মৌলবাদীর ভয়! জানি না, তবে এটা জানি, সাহসী সম্পাদকের বড় অভাব পশ্চিমবঙ্গে।

বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি। লেখায় কাঁচি চালান সম্পাদকরা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। তারপরও লিখতে চেয়েছি পত্রিকায়। আমার কাছে সিএনএন বিবিসির চেয়ে বেশি জরুরি দেশি মিডিয়া। আমি বাঙালি লেখক, আমি বাংলা পত্রিকা চাই লেখার জন্য। যে কথা অন্য কেউ বলে না, সে কথা বলতে চাই।

অনেক কাল পর লিখছি আবার পত্রিকায়। শুধু বাংলাদেশের পত্রিকায় নয়, বেশ কিছু ভারতের পত্রিকাতেও। সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ আমাকে গ্রহণ করার জন্য। যে কথাগুলো আমি বলি, তা শুনলে সরকারের ভালো লাগবে না, মৌলবাদীদের ভালো লাগবে না, নারীবিদ্বেষীদের ভালো লাগবে না। তারপরও সাহস করে আমার লেখা প্রকাশ করছেন। এই সাহসটিই আজকাল বড় দুষ্প্রাপ্য। সময় মনে হয় দিন দিন খারাপ হচ্ছে, কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন কমছে, মত প্রকাশের অধিকারও আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছে। আশির দশকে যে কড়া ভাষায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখতে পারতাম, তার শতভাগের একভাগও এখন সম্ভব নয়।

 

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর