শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী’

আনোয়ারা সৈয়দ হক

‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী’

অনেক বাঙালি লেখককে দেশে-বিদেশে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বা তাদের লেখা গল্প-উপন্যাসে উপরের পঙিক্তটি নিয়ে গর্ব করে আলোচনা করতে দেখা যায়। আমি তাদের বক্তব্য শুনে বহুদিন ধরে ভাবি এ সম্পর্কে কিছু বলব। কিন্তু আমার কথার দাম কতটুকু বা আমি তো কোনো ভাষা পণ্ডিত নই। এসব ভেবে চুপ করে থাকি। তা ছাড়া এসব বই পড়ার অভিজ্ঞতাই বা আমার কতটুকু। কিন্তু আমার মনে হয় সত্য তিক্ত হলেও তা স্পষ্ট হওয়া ভালো।

চর্যাগীতির পুঁথি যাকে আমরা চর্যাপদ নামে সাধারণত জানি সেখানে বৌদ্ধ কবিদের রচিত অনেক পদ রচনা করা আছে। তার ভিতরেই উপরে উল্লিখিত পঙিক্তটি একটি পদের প্রথম লাইন। চর্যাগীতির কবিদের নাম আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে অদ্ভুত শোনালেও আসলে তারা ছিলেন পদ রচয়িতা কবিবৃন্দ। তাদের নামগুলো ছিল এমন—লুইপা, কুক্করীপা, ডোম্বীপা, সরহপা, দারিকপা, কাহ্নুপা, শান্তিপা ইত্যাদি। এ রকম ভুসুকুপাও ছিলেন পদ রচয়িতা একজন কবি।

চর্যাগীতি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে একটি প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে সবাই মানেন। এগুলোর রচয়িতা বৌদ্ধ ধর্মের সাধকরা। নিজেদের ধর্ম সংগীত হিসেবে তারা এগুলো রচনা করেছিলেন। কালের গতির সীমায় বৌদ্ধ ধর্ম ক্রমশ এই ভারত ভূমি থেকে দূরে সরে গেলে সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে পঙিক্তগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলা পুঁথি সংগ্রাহক পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবারের গ্রন্থাগার থেকে চারটি পুঁথি উদ্ধার করেন। তার ভিতরে ‘চর্য্যাচয্যানিশ্চয়’ নামের পুঁথিটি হলো বাংলা পুঁথি। এই পুঁথিতে যেসব রচনা আছে, তাদের চর্যাপদ নামে পরিচয় দেওয়া হয়। এর ভিতরে কিছু পদ ভুসুকুপা রচিত। খুব সম্ভব তিনি বেঁচে ছিলেন ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে। সেটি ছিল ৭৭০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ। কবি ভুসুকু তার বিভিন্ন পদ রচনার ভিতরে বাংলাদেশের পদ্মা নদী ও বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন। ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী’ বলে পদটি যেহেতু তিনি রচনা করেছেন, অতএব, তিনি বাঙালি বটে, এ কথাটি ভাবতে বাঙালিদের গর্ববোধ হয় এবং সেটা স্বাভাবিক বটে। কিন্তু সত্যি কি ভুসুকু বাঙালি ছিলেন? আমরা এখনো জানি না। সত্যি তিনি একজন বাংলার মানুষ ছিলেন কিনা, তার প্রমাণ আমরা এখনো পাইনি। তিনি বিহারের কবিও হতে পারেন অনায়াসে। বিহারিরা ভুসুকুকে বিহারের কবি বলেই দাবি করেন। তিনি নালন্দার শিক্ষক ছিলেন বলেই যে বাংলার মানুষ হবেন, এ ধারণা ভুল। কারণ নালন্দার অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন বাংলাদেশের বাইরে থেকে আসা।

তারপর পদের দ্বিতীয় পঙিক্তটি আমাকে আরও বেশি করে ভাবায় যে, তিনি সত্যি বাঙালি ছিলেন কী না।

যদি তার পদের প্রথম পঙিক্তটি হয়, ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী’, তো তার পরের পদটি হচ্ছে, নিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী’। অর্থাৎ ভুসুকু আজ বাঙালি হয়ে গেলে, যেহেতু এক চণ্ডাল তার ঘরণীকে ‘লিয়ে’ চলে গেছে, অর্থাৎ ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেছে এবং সেই চণ্ডাল আর কেউ নয়, একজন ‘বাঙালি’ এবং বাঙালি তখন গণ্ডিবদ্ধ অর্থে ডোম, চণ্ডাল, মুচি, নমঃশূদ্র এবং এ রকম নিম্নমানের মানুষ। চণ্ডাল এই বাংলাদেশে কোনো দিন বিহারি ছিল না। কিন্তু ভুসুকু নিজে বিহারি হতে পারে। এবং কে না জানে বিহারি চিরকাল বাঙালিদের ঘৃণা করে।

নিজের ঘরণীকে একজন নিম্নজাতের ‘বঙ্গালী’ চণ্ডালে ভাগিয়ে নিয়ে গেলে কবি ভুসুকুর তাতে আনন্দ কোথায়? কোনো নীচ প্রকৃতির স্বামী নিজের ঘরণীকে একজন চণ্ডাল নিয়ে গেছে শুনে নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করবে? দাবি করবে তখনই, যখন সে আত্মগ্লানিতে ভুগবে। যখন মনে হবে সে নিজেও বুঝি সেই রকম নিম্নস্তরের লোক, একজন ‘বঙ্গালী’ চণ্ডাল, যে চণ্ডাল হয় ডোম, মেথর, তাঁতি, মুচি, জেলে, নমঃশূদ্র ইত্যাদি। আর শুধু অপরের বউ চুরি করা নয়, সমাজের সব ধরনের খারাপ এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তখন এসব নিম্নজাতের মানুষ সম্পৃক্ত ছিল। এবং যেহেতু তারা ছিল সমাজের অন্তজ, তাই তাদের ভিতরে সর্বদাই চুরি, মিথ্যা কথা বলা, রাহাজানি, পরের স্ত্রী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এ রকম প্রায়ই ঘটনা ঘটত। আর ঘটত বলেই ‘বঙ্গালীরা’ তখনকার সমাজের উচ্চস্তর বা বর্ণের মানুষদের কাছে ছিল একটি নিম্ন রুচিগোষ্ঠীর মানুষ।

ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতে ‘বঙ্গালী’র এ রকম খারাপ স্বভাবধর্মের বর্ণনা পাওয়া যায়। বস্তুতপক্ষে তখনকার দিনের কোনো ঐতিহাসিকই ‘বঙ্গালী’কে ভালো জাতের বা সৎ বংশের মানুষ বলে মনে করতেন না। নিরপেক্ষভাবে এই ঐতিহাসিক সত্যসত্যের বিচার করতে বসলে, ‘বঙ্গালী’র ভিতরে অতিশয় খারাপ গুণগুলোর ফিরিস্তিই আমরা পাই। তার ভিতরে অলসতা এবং মিথ্যা কথা বলা সবচেয়ে উপরের সারিতে অবস্থান নিয়েছে। এই বঙ্গালীর ঘরের রমণীরা তখন যথেষ্ট স্বাধীনতাবোধী নারীগোষ্ঠী। তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ছিল। এখনো আছে। এবং তাদের ঘরের পুরুষরা একে-অন্যের রমণীকে অনায়াসে নিজেদের জীবনে তুলে নিত। এর জন্য কতটুকু যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হতো, আমরা জানি না। সমাজ বা সংস্কারের ভয় তাদের ছিল না। তারা শিক্ষিত বা অভিজাত বা বংশ গৌরবে গৌরবান্বিত ছিল না। তারা এসবের ধারও ধারত না। তাদের ভিতরে রিপুর তাড়নাকে তারা খারাপ দৃষ্টিতেও দেখত না।

কারণ তারা ছিল প্রকৃতির সন্তান স্বাধীনচেতা একদল মানুষ।

কিন্তু উচ্চবংশীয় ভুসুকুর কাছে বাংলাদেশে শিক্ষকতা করতে এসে যদি নিজের রমণীকে নিজ বংশীয় কোনো চণ্ডাল হাতিয়ে নিয়ে যায়, তখন আত্মশ্লাঘায় জর্জরিত উচ্চ বংশের ভুসুকুরও নিজেকে বঙ্গালী বলে পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। তিনি তাই নিজেকে ‘বঙ্গালী’ বলে ব্যঙ্গ করছেন, নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন! আর সেই ধিক্কারকে আমরা প্রশংসা মনে করে পথঘাট গরম করে বেড়াচ্ছি!

ভুসুকুর বক্তব্য হচ্ছে, তিনি নিম্ন জাতের ‘বঙ্গাল’ না হলে তার স্ত্রী ঘর ছেড়ে কেন চলে গেল? যা হরহামেশা ‘বঙ্গালী’র ঘরে হয়, সেই ঘটনা অভিজাত কবি ভুসুকুর ঘরে ঘটল কী করে?

কবি ভুসুকু এমনই রাগান্বিত যে, একবারও তার স্ত্রীর কষ্টের কথা ভাবলেন না। যে স্বামী রাত দিন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং বাড়ি ফিরে এসে কবিতা রচনা করতে বসেন, তার স্ত্রী ঘর ছাড়বে না তো কী করবে? তিনিও কি তার মতো কবি হবেন? সেই ক্ষমতা কি তার ছিল?

অথবা কবি ভুসুকু হয়তো নালন্দায় শিক্ষকতা করার জন্য দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে বাইরে ছিলেন এবং হয়তো ভেবেছিলেন যে, বড় বংশের নারীরা জীবনেও কোনো দিনই স্বামীগৃহ ত্যাগ করতে পারবে না, যেহেতু বংশে কলঙ্ক লেপন কোনো বড় ঘরের নারী করতে পারে না। এসব কাণ্ড-কারখানা ছিল ছোট বংশের ঘরের নারীদের কাজ। কারণ ছোট বংশের নারীরা স্বামীর দীর্ঘদিনের শারীরিক অনুপস্থিতি অন্য পুরুষকে দিয়ে পুষিয়ে নিত। কিন্তু কবি ভুসুকুর ভুল ভাঙিয়ে তার নারীটি অর্থাৎ স্ত্রীটি দিব্যি একজন ‘বঙ্গালী’র সঙ্গে কবি ভুসুকুর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এ লজ্জা তিনি রাখবেন কোথায়?

তাই তো তার কণ্ঠস্বর আক্ষেপে জর্জরিত হয়ে উঠেছে। আক্ষেপ তার নিজের ঘরণী এক চণ্ডালের হাত ধরে ভুসুকুর সংসার ত্যাগ করেছে এবং সেই চণ্ডাল আর কেউ নয়, একজন বঙ্গালী।

‘বঙ্গালী’ না হলে তার বউ ঘর ছেড়ে চলে গেল কী করে? এ ধরনের অসামাজিক কাজ তো শুধু বঙ্গালীদের ঘরেই হয়। সেই সময় বাংলাদেশে কি বাঙালি ব্রাহ্মণেরা ছিলেন? মনে হয় না। উত্তর ভারত থেকে কি ততদিনে জাতগর্বে ব্রাহ্মণেরা এ দেশে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন? মনে হয় না। সে সময় বাংলাদেশে ছিলেন শুধু তথাকথিত নিম্নজাত ও পাতের মানুষেরা যাদের ‘বঙ্গালী’ বলা হতো। আমার মনে হয় আমাদের দেশের ইতিহাসবিদরা হয়তো পুরো ব্যাপারটা জানতে পারেন। জাতে ভুসুকু নিশ্চয় বিহারের ব্রাহ্মণ ছিলেন। স্ত্রী হঠাৎ ঘর ছেড়ে একজন চণ্ডালের হাত ধরে চলে গেলে ভুসুকুর মর্যাদা থাকল কোথায়? ব্রাহ্মণ ভুসুকু তখন খেদের সঙ্গে অন্তজ চণ্ডালের সমকক্ষ হচ্ছেন। তা নইলে তার যদি জন্মই হতো বঙ্গালীর ঘরে, তাহলে তো আবার নিজেকে ‘বঙ্গালী’ত্বে রূপান্তরিত হওয়ার কারণ ঘটত না।

তাই কবি-সাহিত্যিকদের কাছে অনুরোধ, আপনারা কবি ভুসুকুর ভুল মেসেজ নিয়ে মতামাতি করবেন না। কারণ কবি ভুসুকু আমাদের কেউ নন। ভালো করে আবার পড়ে দেখুন তার পদাবলীর পঙিক্ত দুটি :

‘আজ ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী

ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী’।

মূলত আমরা হচ্ছি অন্তজ বঙ্গালী। কিন্তু তাতে আমাদের কোনো খেদ বা লজ্জা নেই। কোনোভাবেই ছিল না। চাঁদের ক্রম পরিক্রমায় আমরা আজ চণ্ডাল অভিধা থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে কর্মক্ষম, সবচেয়ে পরিশ্রমী, উদ্ভাবনী শক্তিতে সবচেয়ে সৃজনশীল, সশস্ত্র সংগ্রামের ভিতর দিয়ে শৃঙ্খলিত বাংলাকে উদ্ধার করা সবচেয়ে সাহসী, হিমালয়ের চূড়াছোঁয়া এক বাঙালি জাতি। এককালের ‘বঙ্গাল’ থেকে আমরা গর্বিত এক বাঙালি জাতি। তাই আমাদের অর্জিত প্রশংসার কোনো দাবিদার এই বিহারি কবি ভুসুকু নয়। বরং তার ব্যঙ্গ কটুক্তিকে আমরা আজ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর