বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু নেই, আছে আদর্শ নীতি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বঙ্গবন্ধু নেই, আছে আদর্শ নীতি

ড্রয়িং : শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী

আজ সেই কালো ১৫ আগস্ট। ৪৭ বছর আগে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের জন্মদাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে জিয়া এবং খন্দকার বাহিনী মার্শাল ল’ জারি করে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। সেদিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। খবরের কাগজ বন্ধ ছিল। অর্থাৎ ১৬ আগস্ট কলকাতা থেকে কোনো সংবাদপত্র বের হয়নি। ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায় রেডিওর মাধ্যমে। আমার মনে আছে ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব সরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় আমাকে ফোনে ওই দুঃসংবাদটি দেন। আমিও তখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। রেডিওর খবর শুনে শত শত লোক রাস্তায় বেরিয়ে ক্ষোভ ও ধিক্কার প্রকাশ করছে। এই খবর বিশ্বে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হলো শোকাহত।

বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেফতার করা হলো। গৃহবন্দী করা হলো মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবু হেনা কামারুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে। খন্দকারকে কিছুদিনের জন্য জিয়া রাষ্ট্রপতি করে রেখে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন। জিয়া চেয়েছিলেন মুজিব মন্ত্রিসভার সব মন্ত্রীকে এনে খন্দকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়াতে। কিন্তু প্রথম সারির নেতারা কেউ জিয়ার পিস্তলের কাছে মাথানত করেননি। শুধু প্রাণের ভয়ে মুজিব মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী দিনাজপুরের ইউসুফ আলী এবং টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান যোগ দিয়েছিলেন। এরা দুজনই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। এরা দুজনই কামারুজ্জামানের সঙ্গে কাজ করতেন। আমি বহু কষ্ট করে আমার বিশেষ বন্ধু অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ফোন করেছিলাম। ইউসুফ আলীর সব কথা আমি বুঝতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে এনে তাকে মন্ত্রী বানানো হয়েছিল।

তাজউদ্দীন সাহেব। পরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে শুনেছি, লুঙ্গি পরে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ভারতের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের বাকি তিন মন্ত্রীকেও জেলে পুরে দেওয়া হয়। লাগামহীন এ অত্যাচার গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়িকা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী খবরটি যখন পেলেন, তখন তিনি দিল্লির ২ নম্বর সফদর জং রোডের বাড়িতে। তিনি মুজিব ভাই, মুজিব ভাই বলে চিৎকার করতে করতে রাতের পোশাক পরেই বেরিয়ে এলেন। তাঁর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্রবধূ মানেকা গান্ধী, যিনি এখন বিজেপি সরকারের মন্ত্রী। তার মুখেই আমার এ কথা শোনা। সেদিন চিৎকার করে তাঁর একান্ত সচিব ধাওয়ানকে বললেন, সব মন্ত্রীকে খবর দিতে। ওই রাতেই এক এক করে মন্ত্রীরা তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হন। ডেকে নেওয়া হয় চিফ অব আর্মি স্টাফ শ্যাম মানেকশকেও। তাদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। কোনো কোনো মন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই রাতেই বাংলাদেশে সেনা পাঠিয়ে দেশটিকে জিয়া-খন্দকারমুক্ত করা হোক।

’৭১-এর যুদ্ধচলাকালীন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম ইন্দিরা গান্ধীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলেন, আমরা আমাদের হাইকমিশনারের রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। ঢাকা থেকে রেডিও মারফত যেটুকু খবর পাওয়া গিয়েছিল সস্ত্রীক মুজিব ও তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যার বিস্তারিত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে।

হাইকমিশনার সমর সেন সেদিন ছুটিতে কলকাতায় ছিলেন। জিয়া-খন্দকার জুটি ভারতের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু ঢাকার বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার বলা হচ্ছিল মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। কেউ অমান্য করলেই তাকে গুলি করে মারা হবে।

ইতিমধ্যে ইন্দিরার কাছে খবর এলো— তাঁর দুুই কন্যা, জামাতা এবং তাঁদের শিশু সন্তানরা তখন জার্মানিতে। তাই আল্লাহর দয়ায় তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর একান্ত সচিব আর কে ধাওয়ানকে নির্দেশ দিলেন, যে বাঙালি মন্ত্রীরা দিল্লিতে আছেন তাদের ডাকো। দেখা গেল গণ-সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে ইন্দিরা গান্ধী বন-এ ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোটবোন শেখ রেহানাকে রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে আনার নির্দেশ দেন। প্রণব বাবুকে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব বিমান এয়ারফোর্স-ওয়ান দিয়ে তখনই জার্মানি পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাদের দিল্লি নিয়ে আসার জন্য। প্রণব বাবু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতো জার্মানিতে গিয়ে তাদের দিল্লিতে নিয়ে এসে পান্ডারা রোডের একটি ফ্ল্যাটে তোলেন।

বস্তুত, ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা এবং ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র শুরু হয় ওয়াশিংটন, ইসলামাবাদ এবং কলকাতার মার্কিন দূতাবাস থেকে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ঢাকায় থাকাকালীন লক্ষ্য করেছি, ঢাকায় কিছু গোপন থাকে না। জিয়া প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব তত্ক্ষণাৎ জিয়াকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আমাকে খোঁজ করেছিলেন। আমি তখন কলকাতায়। কয়েকদিন পর ঢাকায় ফিরে গেলে আমার সহকর্মী সে কথা জানিয়ে বললেন, তাজউদ্দীন সাহেব বার বার খোঁজ করছেন। একবার ফোন কর।

তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে জিয়ার ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত জানিয়ে বললেন, আপনি এখনই কলকাতায় ফিরে গিয়ে বিএসএফ-এর গোলক মজুমদারকে ঘটনাটা জানান। গোলক বাবুকে সব জানানোর পর আমি আবার ঢাকায় ফিরে গিয়ে তাজউদ্দীনকে সব জানাই। এরপর ঢাকায় যেখানে গেছি সেখানেই শুনেছি, বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। তাঁকে হত্যাও করা হতে পারে। আমি তখন নিয়মিত বিকালের দিকে খবর সংগ্রহের জন্য গণভবনে যেতাম। কখনো তোফায়েল সাহেবের ঘরে, কখনো বাইরে বেঞ্চে বসে থাকতাম। একদিন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু আমার বুকের ওপর একটা ঘুষি মেরে বললেন, আপনি বরিশালের পোলা না। আমি জাতির পিতা। আমাকে কেউ মারবে না। এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তিনি নিজের দেশবাসীকে এত ভালোবাসতেন যে, কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারে এমনটা ভাবতেও পারতেন না। কিন্তু তাই হলো।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্র তারিখটা আমার মনে নেই। সম্ভবত ১৯৭২ সালের ১৩ কী ১৪ জানুয়ারি। আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ওই চার নেতার চুক্তি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় এবং আমাকে প্রথম সাক্ষাৎকারটি করিয়ে দিতে হবে। তখন ঢাকার কন্টিনেন্টাল হোটেলে থাকি। আমার সঙ্গে ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার বর্তমান প্রধান অরূপ সরকার। রাতে ফোন পেলাম সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে যেন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। আমরা তাই করলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে কামারুজ্জামান সাহেব একটা গাড়ি নিয়ে এসে বললেন, ওঠ। গাড়িতে যেতে যেতে তিনি বললেন, তোমার কথা সব বলেছি। উনি খুব খুশি হয়েছেন। আমার বুক তখন দুরুদুরু করছিল।

৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে দেখি আমাদের আগেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন সাহেব বসে আছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমরা কী করেছ সব জানি। এই বলে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন ভিতরে। দেখালেন তাঁর সব বই ইয়াহিয়া খানের সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রপ্রিয় শেখ মুজিবের চোখ দিয়ে তখন জল পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের একটি আধপোড়া বই আমাদের হাতে তুলে দিলেন। অরূপ বাবু আমাকে ইঙ্গিতে বললেন, বলে দিন, দুই দিনের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ রবীন্দ্র রচনাবলি পাবেন। আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম। কামারুজ্জামান সাহেব আমাদের ঘরে এলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বঙ্গবন্ধু যে ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে উঠে এসেছেন তার ইতিহাস শোনালেন। আমরা সেসব কিছুই জানতাম না। শুনছি আর শিউরে উঠছি।

তখন ঢাকা/কলকাতার মধ্যে একটি ডাকোটা বিমান যেত খবরের কাগজ নিয়ে। অরূপ বাবু কলকাতা অফিসে ফোন করে বলে দিলেন, রবীন্দ্র রচনাবলি প্যাকেট করে বিমানে পাঠাতে। দুই দিন পরেই ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে বইগুলো সংগ্রহ করে সোজা ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে চলে যাই।

প্যাকেটগুলো যখন তাঁর ঘরে নামাচ্ছি তখন তিনি লুঙ্গি পরে দাড়ি কাটছিলেন। বইগুলো দেখে এত খুশি হলেন যে, আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আবার তিনি কাঁদতে আরম্ভ করলেন। বইগুলো দেখে তখন তাঁর শিশুর মতো উত্তেজনা শুরু হলো। বললেন, তোমরা দুপুরে আমার বাড়িতে খাবে।

৪৩ বছর আগে এই দিনে জাতির জনককে যারা হত্যা করেছিল তারা কি বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের আটকে রাখতে পেরেছে? তিনি পাকিস্তানিদের বলেছিলেন, আমাকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না। তাঁকে হত্যা করে যারা ভেবেছিল চিরকাল বাংলাদেশ পাকিস্তান আমেরিকার তাঁবে থাকবে, তাদের ধারণা যে ভুল তা প্রমাণ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেই হাসিনাকেও হত্যা করার জন্য একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যেভাবে বাংলাদেশ চালাচ্ছেন, তা বিশ্বের দরবারে নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের আর্থিক অগ্রগতির মূলে রয়েছে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। যতই ষড়যন্ত্র চলুক ৪৩ বছর আগের সেই ঘটনা বাঙালিকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ কারও তাঁবেদার নয়। তাদের ষড়যন্ত্র এখনো থেমে যায়নি। বঙ্গবন্ধু নেই, তাঁর আদর্শ নীতি আছে। আর আছে মানুষ। এই দিনে আমি তাঁর আত্মার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাচ্ছি।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর