২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০১:৪২

'আন্ডারওয়ার্ল্ড' বইটি হতে পারে রেফারেন্স বুক

এইচ এম বাবু:

'আন্ডারওয়ার্ল্ড' বইটি হতে পারে রেফারেন্স বুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজধানী জুড়ে যে আন্ডারওর্য়াল্ড, মাফিয়া ডনদের বিচরণ- তার অনুসন্ধানী, গতি প্রকৃতি, তথ্য নির্ভর ও লোমহর্ষক কর্মকান্ড নিয়ে অসাধারণ গবেষণা বই "আন্ডারওর্য়াল্ড"। লিখেছেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক পাপারাজি, ক্রাইম রিপোটার্র মির্জা মেহেদি তমাল ভাই। দুই দশকের পেশাগত জীবনে তিনি ক্রাইম ও আন্ডারওয়ার্ল্ড সংক্রান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও তথ্য উপস্থাপন করেছেন বইটিতে। 

বইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগ, অপরাধ মনোবিজ্ঞান বা পুলিশ প্রশাসনের প্রিলিমিনারি রিসার্চ বুক হতে পারে।আর এ প্রজন্মে ক্রাইম রিপোর্টারদের রেফারেন্স বুক হতে পারে বইটি। বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে অন্বেষা প্রকাশনীতে। 
 
মূলত রাজধানীতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজনীতি, দর্শন, মনস্ততাত্ত্বিক ফ্যাক্ট, কেস স্টাডি, ইতিহাস, তাদের সাম্রাজ্য ও দুর্ধর্ষতা নিয়ে বাংলাদেশে এতো গভীরে কাজ আগে কখনো হয়নি। তবে, ৯০ দশকে বিটিভিতে বোরহান কবিরের জনপ্রিয় ক্রাইম সাপ্তাহিক "পরিপ্রেক্ষিতে" উঠে এসেছিল।

৫০ বছর আগের নৃশংস কর্মকান্ড নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা সত্যি কঠিন। কারণ, সে সময়ের ডনদের সাম্রাজ্য নিয়ে নেই কোন পুস্তক, দালিলিক প্রমাণ। কেস স্টাডি হিসেবে রেফারেন্স শুধু- লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তখনকার পত্র-পত্রিকা। 

এ দেশের ডনদের ফিল্মি স্টাইলের কর্মকান্ড দেখে যে কারও পিলে চমকে যাবে। কাউকে হত্যার পর দুধ দিয়ে গোসল করা, মৃত্যুর পরও লাফিয়ে লাফিয়ে পাঁজর ভাঙ্গা, ইনফরমার হিসেবে ফিল্মের নায়িকাদের ব্যবহার, দিনের আলোতে হত্যার স্বাদ, কারো আবার ফিনকি দিয়ে রক্তের স্রোত দেখার সাধ, গ্যাং কিলিং, মিসটোরিয়াস কিলিং, সাইলেন্ট কিলিং, সিরিয়াল কিলিং, পুলিশ মার্ডারের স্বাদ, মন্ত্রীর বাড়ি দখল, মরফিন, আফিম, হেরোইন, নানা রকম ড্রাগ, অস্ত্রসহ ব্যবসা, বৈঠকি খুন সব উঠে এসেছে বইটিতে।

সেভেন স্টার, ফাইভ স্টার গ্রুপের জন্ম ও বিনাশ কিভাবে? পুলিশ এসি আকরামের সাহসিকতা, সুইডেন আসলাম, ইমদু, কামাল, পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, ব্যাঙগা বাবু, কালা জাহাঙ্গীর, মুরগি মিলন, লিয়াকত, তিব্বত, বিকাশ, প্রকাশ, জোসেফ, মোল্লা মাসুদের কর্মকান্ড। এদের ব্যক্তি জীবন বেশ রোমাঞ্চকর। যেমন: কেউ ফিল্মের গায়ক, কেউ মার্শাল আট্রিস্ট, কারো আছে মাজার, কাফনের পোশাক পরতে ভালোবাসেন কেউ, ৮/৯ ফুট ১১টি দেয়াল লাফানোর দক্ষতা, খুন করাই যাদের আনন্দ, হাতুড়ি দিয়ে থেতলে মারার দক্ষতা, ব্রাস ফায়ার- একে ৪৭ চালানোর পারদর্শিতা, আবার নির্মমভাবে হত্যা করে গহনা পরতো তারা। 

এরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন সরকারের শক্তি হিসেবে কাজ করতো। প্রেসিডেন্ট এরশাদ, জিয়াউর রহমান, আওয়ামী মন্ত্রী, জামাতের আমীর তাদের পাশে ছিল। মোল্লা মাসুদ সরাসরি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পিএস ছিল। ফাইভ স্টার গ্রুপের কোন মিশনে মোল্লা মাসুদের আগে কেউ গুলি করতে পারবে না, এটাই ছিল নিয়ম। কারাগারে বসেই চলতো সমস্ত কর্মকান্ড। আন্তজাতির্ক বিশ্বে ছিল শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। প্রত্যেকে মারা গেছে প্রতিপক্ষের গুলিতে, গ্যাং যুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে। কিংবা দেশান্তরী হয়েছে। 

নিজেদের রাজনৈতিক কোন আদর্শ ছিল না। কন্ট্রাক, দখল, হত্যা, অর্থ ছিল মূল উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেখ মনিকেও হত্যার সমস্ত নকশা এঁকেছিল। সামান্য উনিশ-বিশের কারণে ডনদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যায় শেখ মনি।
 
বইটির প্রতিটি পাতায় আছে সোর্স, গবেষণা, তথ্য ও ফিচার স্টাইলে লেখার ধাচ। ৯৬ পাতার বইটি পড়ে কখনো মনে হয়নি এটা একজন ক্রাইম রিপোর্টারের লেখা। আছে নান্দনিকতার ছোঁয়া, কল্পনা শক্তি, স্টাইল। 

তবে, অনেক ঘটনার রেফারেন্স, স্থান, প্লট বর্ণনা করেননি লেখক। এটা আমার কাছে দুর্বল একটি দিক মনে হয়েছে। পুরান টাকা কেন্দ্রীক আন্ডারওয়ার্ল্ডদের স্বর্গ উল্লেখ করলেও নতুন ঢাকাকে একদমই এড়িয়ে গেছেন। কেস স্টাডি হিসেবে বনানীতে সোহেল চৌধুরী হত্যা, ইমরান, আজিজ মোহম্মদ প্রমুখ তার গবেষণায় আসতে পারতো। নিউটন মার্ডার হয়েছিল সোবহান বাগের লাকি প্লাজায় দ্বিতীয় তলার সেলুনে। ওইদিন নিউটনের ভাইয়ের বিয়ে অনুষ্ঠান ছিল। হত্যার স্থান ও প্রক্ষাপট বর্ণনা করলে রিডারদের মাঝে কল্পনা শক্তি কাজ করে। যেটা অনেক ক্ষেত্রে আসেনি। ২০১৩ তে মিল্কি ভাই মার্ডারের বিষয়টা শুধু তারেকের উপর দিয়ে চলে গেছে। মূল হোতার নাম এড়িয়ে গেছেন।

লেখকের কাছে আন্ডারওয়াল্ডের আরও কয়েক জনের নাম প্রত্যাশা করেছিলাম। কারওয়ান বাজার, কমলাপুর, বিএনপি বস্তি, হাজারীবাগ, গনেশটুলি ইত্যাদি স্থানের ডনদের নাম আসেনি। তবে, দুর্বলতা যতটুকু থাকুক না কেন আমার দৃষ্টিতে সফলতার ভাগ ৯৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে ইতিহাস গড়েছেন, অসাধারণ একটি কাজ করেছেন তমাল। সামনে আরও চমক প্রত্যাশা করছি।

লেখক: সাংবাদিক

 

বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর