৩১ মে, ২০১৮ ২৩:৩৩

'আম' নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড়!

রাবি প্রতিনিধি

'আম' নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড়!

বস্তাভরে গাছ থেকে আম লুট করার সময় আনোয়ার হোসেন আনু নামের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থীকে পুলিশে সোপর্দ করা নিয়ে ক্যাম্পাসে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। 

শিক্ষার্থীকে পুলিশে দেয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচর্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার নামে ‘অপপ্রচারণা’ চালানো হচ্ছে বলে দাবি করছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সদস্যরা।

তারা বলছে, আনু নামের ছেলেটিকে পুলিশে দেয়ার সঙ্গে উপ-উপাচার্যের কোনো সম্পর্ক নেই। অস্বাভাবিক আচরণের জন্য পুলিশ সদস্যরা আনুকে থানায় নিয়ে গেছলো।

নগরীরর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ক্যাম্পাস থেকে আমি খবর পাই সেখানে দু-একটি ছেলে খুবই অসংলগ্ন আচরণ করছে। তখন আমি সেখানে ফোর্স পাঠাই। এছাড়াও আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই ছেলেটা মাদকাসক্ত। তাই আমরা নিজেরাই ছেলেটাকে থানায় নিয়ে আসি। পরবর্তীতে প্রক্টরের জিম্মায় ওই ছেলেকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে। তবে কে বা কারা প্রো-ভিসিকে নিয়ে একটা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। তাছাড়া ছেলেটাকে থানায় নিয়ে আসার পর প্রো-ভিসি স্যার নিজেই আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়ে ছেলেটাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য বলেছিলেন। 

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার সন্ধ্যায় পুরাতন ফোকলোর এলাকার বাগান থেকে আম পাড়ছিল পপুলেশন সায়েন্স এন্ড হিউম্যান রিসার্চ বিভাগের শিক্ষার্থী আনু এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী পলাশ। ওই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দফতরের প্রশাসক ড.এফ এম আলী হায়দার। তিনি আনু ও পলাশকে ডেকে গাছগুলো লিজ হয়েছে জানিয়ে আম পাড়তে নিষেধ করেন। 

এ সময় শিক্ষকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে আনু। পরে শিক্ষক আলী হায়দার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহাকে জানান। এসময় আনুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। ঘটনা শোনার পর আনুকে ছাড়াতে থানায় যান সাংস্কৃতিক জোটের নেতাকর্মীরা

এনময় থানায় আনু পুলিশকে জানায়, অল্প বয়সে তার বাবা-মার মধ্যে পারিবারিক কলহের কারণে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাকে তার এক আত্মীয় অভাবের সংসারে কোনও রকম লালন পালন করে স্কুল পাশ করান। এরপর তিনি প্রাইভেট টিউশনি যোগাড় করে নিজের চেষ্টাতেই ইন্টার পাশ করেন। ফল ভালো হওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্সে ভর্তি হন। এরমধ্যে পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ যতটুকু ছিল ততটুকুও ছিন্ন হয়ে যায়। রমজান শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে তার হাতে কোনো টিউশনি নেই। ক্যাম্পাস ও এর আশেপাশের  বিভিন্ন দোকান থেকে বাকিতে খেয়ে দিন পার করছিলেন। ক্ষুধা নিবারণের জন্যই তিনি আম পেড়েছিলেন।

এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা শুনার পর ক্ষুব্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরা। গাছ থেকে আম পাড়ার অভিযোগ উপ-উপাচার্য শিক্ষার্থীকে পুলিশে দিয়েছে বলে ফেসবুকে প্রচার করা হয়। সেই সঙ্গে আনুর হৃদয় বিদারক সেই ঘটনাটিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়।  কয়েকটি পত্রিকাও এনিয়ে সংবাদ প্রচার করে।

তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দফতরের প্রশাসক অধ্যাপক ড. এফ এম আলী হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে ঘটনার সঙ্গে প্রো-ভিসি স্যারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আমি পশ্চিমপাড়া থেকে জুবেরি ভবনের দিকে আসছিলাম। আমি জুবেরি ভবনের কাছে এসে দেখি-ভবনের উত্তর দিকের বাগান থেকে দুটি ছেলে বস্তায় করে আম নিয়ে যাচ্ছে। তখন তাদেরকে আমি দাঁড়াতে বলি। তারা কেন বস্তায় করে আম পেড়েছে সেই বিষয়টি আমি জানতে চাই। প্রত্যুত্তরে তারা আমার সাথে খুবেই অস্বাভাবিক আচরণ করে। তখন আমি তাদেরকে সেখানে দাঁড় করে রেখে প্রো-ভিসি স্যারকে ফোন করি। পরে স্যার সেখানে এসে তাদের কাছে এতোগুলো আম কেন পেড়েছে তা জানতে চান। প্রো-ভিসি স্যারের সঙ্গেও ওই শিক্ষার্থী খুব বাজে আচরণ করে। তার এই ধরণের আচরণ দেখে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে, ছেলেটি মাদকাসক্ত হতে পারে। তাই সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই ওই শিক্ষার্থীকে থানায় নিয়ে যায়।’

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রলীগের সহসভাপতি জাকিরুল ইসলাম জ্যাক জানান, আনু সেখানে স্যারদের সঙ্গে যে অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল তাতে উপস্থিত সকলেই মনে করছিল ছেলেটা হয়তো নেসাগ্রস্ত। তাই পুলিশ সদস্যরাই আনুকে থানায় নিয়ে গেছলো। 

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আনু ছেলেটার আচরণে যে অস্বাভাবিকতা ছিল তা দেখে পুলিশ সদস্যরা তাকে থানায় নিয়ে গেছলো। তারপরও কেউ কেউ আমাকে দোষারোপ করছে যে-আমি ওই ছেলেকে পুলিশে দিয়েছে। কিন্তু কেন তারা আমার নামে এই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না। ছেলেটাকে যখন থানায় নিয়ে গিয়েছিলো তারপর নিজেই তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। থানা থেকে ছেড়ে দেয়ার জন্য পুলিশকে বলেছি। কিভাবে ছেলেটার পুর্নাবসন করা যায় সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই আমাকে নিয়ে গুজব রটানো শুরু হলো।

তবে আনোয়ার হোসেন আনুর মাদক গ্রহণের বিষয়টি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ছাত্রমৈত্রির সভাপতি ফিদেল মনির। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আমাদের কমিটিতে প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিল আনু। কমিটি ঘোষণার পর থেকে দেখি আনু সাংগাঠনিক কাজে তৎপর না। পাশাপাশি সে মাদকে আসক্ত। মাদক ছাড়ার জন্য তাকে আমরা বেশ কয়েকবার বলেছিলাম। কিন্তু সে কোনোভাবেই মাদক ছাড়তে পারছিল না। তাই তাকে আমরা গত ১ মার্চ দল থেকে বহিষ্কার করি।’

এদিকে আনুর কয়েক সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবারে আর্থিক সমস্যা থাকায় তার চাচাতো ভাই ইয়াকুব আলী তাকে পড়াশোনার খরচ দিতেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পরিবারের লোকেরা জানতে পারেন আনু মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তাকে অনেকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে নেশা না ছাড়ায় তার ভাই ইয়াকুব তাকে টাকা দেয়া বন্ধ করেন।

এবিষয়ে আনুর চাচাতো ভাই ইয়াকুব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। সেখানে আমি আমি খোঁজ নিয়ে শুনেছি আনু মাদকাসক্তক। তাকে নেশা ছাড়ার জন্য কয়েকবার বলাও হয়েছিল। কিন্তু সে নেশা ছাড়েনি। তাই তার পড়াশুনার খরচ দেয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’

তবে স্কুল-কলেজে থাকাকালীন আনোয়ার হোসেন আনু খুবেই ভাল স্বভাবের ছেলে ছিল বলে দাবি তার এলাকার সহপাঠী রোহান ইসলাম। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে আনু খুব ভাল ছেলে বলে জেনেছি। স্কুল-কলেজে সে কখনো মাদকাসক্ত ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পারিবারিক কারণেই হয়তো সে পথভ্রস্ত হয়েছে।

আনুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মনির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথমবর্ষে পড়ার সময় আনু কখনো নেশা করছে বলে আমার জানা নেই। তবে পারিবারিব টেনশনে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর থেকেই সে অস্বাভাবিক জীবনে চলে যায়। তাকে যদি ঠিকমতো পুর্নবাসন করা যায়, তবে সে অবশ্যই আবার  স্বাাভাবিক জীবনে ফিরে  আসবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য আনোয়ার হোসেন আনুর ফোনে কয়েকবার ফোন করা হলে তার  ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।


বিডি প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসীর

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর