১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১২:২৭

জাবিতে শিক্ষার্থীদের ঘাঁড়ে বন্দুক রেখে চলছে ভূগোল বিভাগের শিক্ষক রাজনীতি!

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত, জাবিঃ

জাবিতে শিক্ষার্থীদের ঘাঁড়ে বন্দুক রেখে চলছে ভূগোল বিভাগের শিক্ষক রাজনীতি!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চলমান শিক্ষক রাজনীতির অর্ন্তদ্বন্দ্বে ‘বলির পাঠা’ বানানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক রাজনীতির মারপ্যাচে বর্তমানে চরম সংকটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গত দুই সপ্তাহ ধরে বিভাগটিতে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া বন্ধ রেখেছেন শিক্ষকরা। বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল হাসানের বিরুদ্ধে একাডেমিক সভা না ডাকার ‘অজুহাত’ দেখিয়ে এই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন তারা।

শিক্ষকদের এমন কর্মসূচিতে বিভাগটির শিক্ষা কার্যক্রমে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। বিভাগটির প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন পড়েছে অনিশ্চয়তার মুখে। আটকে আছে ৪২তম আবর্তনের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার ব্যবহারিক অংশ। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও শিক্ষার্থীদের চোখে পড়েনি এই সংকট সমাধানের কোনো উদ্যোগ। শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচির কোনো আশু সমাধান দেখতে না পেয়ে অবশেষে গত রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর বিভাগটির শিক্ষার্থীরাই এর সমাধানে নামে।

ওইদিন সকালে প্রতিদিনের মতোই শিক্ষকরা বিভাগে এসেও ক্লাস-পরীক্ষা না নিয়ে নিজেদের অফিস কক্ষে বসে ছিল। বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা সকাল ১১টার দিকে শিক্ষকদেরকে ভেতরে রেখেই বিভাগের মূল ফটকের বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়। তারপর সমবেত কণ্ঠে অবিলম্বে ক্লাস-পরীক্ষা চালুর দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। 

শিক্ষকদের ভেতরে রেখে বিভাগে তালা দেয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, “শিক্ষকরা নিয়মিত বিভাগে যাতায়াত করছেন। কিন্তু কোনো শিক্ষকই আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছেন না। তাই বিভাগেই তাদেরকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর লিখিত আশ্বাস না দেয়া পর্যন্ত তালা খোলা হবে না।” কিন্তু রাত ১২টা বেজে গেলেও লিখিত আশ্বাস না পাওয়ায় তাদের এই অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে!

এই দীর্ঘ সময়েও বিভাগটির শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা চালুর দাবির কোনো লিখিত আশ্বাস দিতে ব্যর্থ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা কয়েক দফা চেষ্টা করেও শিক্ষার্থীদেরকে তাদের অবস্থান থেকে সরাতে পারেননি। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মঞ্জুরুল হক, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডীন অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা হিসেবে পরিচিত কয়েকজন শিক্ষক এসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিভাগটির শিক্ষকরা সংকট সমাধানে কোনো মতানৈক্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। তাই মেলেনা কোনো সমাধানও।

অবশেষে রাত ১২টার সময় বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল হাসান বিভাগের ভিতরে অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা মানবিক দিক বিবেচনা করে বিভাগের তালা খুলে দেন। এ সময় সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডীন অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার আগামী ২০ তারিখ, বৃহস্পতিবার থেকে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর মৌখিক আশ্বাস দেন এবং ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর সকল দায়ভার গ্রহণ করেন।
 
শিক্ষকদের আটকে রেখে ক্লাস-পরীক্ষা চালুর এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ক্লাস-পরীক্ষা আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের প্রশংসাও করেন অনেকেই।

তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের এই সরল ও নির্মোহ আন্দোলনের পেছনেও রয়েছে শিক্ষক রাজনীতির প্রচ্ছন্ন হাত! মূলত শিক্ষকরাই পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেছেন আন্দোলনে যেতে। এই বিষয়ে উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের রাজনীতি। একটি উপাচার্যের পক্ষে অন্যটি বিপক্ষে। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল হাসান মূলত উপাচার্যপন্থি। অন্যদিকে বিভাগটির সাবেক এবং সর্বশেষ সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুর রশিদসহ বিভাগটির বেশিরভাগ শিক্ষকই উপাচার্য বিরোধী।

আর এই বিরোধী পক্ষের শিক্ষকরাই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেছেন আন্দোলনে যেতে। নিজেরা সরাসরি বিভাগীয় সভাপতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে না গিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেছেন আন্দোলন করতে। আর এদিকে শিক্ষার্থীরা যখন নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা না পেয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আন্দোলন শুরু করেছেন তখন এই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনকারী শিক্ষকরাই আবার পেছন থেকে তাদের আন্দোলনে সহযোগিতা করেছেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সচেতন শিক্ষক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “মূলত শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের ঘাঁড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের ব্যক্তিগত ও রাজনেতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালিয়েছেন।”

জানা যায়, সাবেক এবং বর্তমান সভাপতির মধ্যে বিভাগটির সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উপাচার্যপন্থি এবং বিরোধী শিক্ষক রাজনীতির ক্ষমতার দ্বন্দ্বেই বিভাগটির এই সংকটের সূত্রপাত। তাছাড়া বিভাগটির সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে বর্তমান আর সাবেক সভাপতির মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্বের ফলে সান্ধ্যকালীন কোর্স এখন অনেকাংশেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যার কারণে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ক্লাস নেওয়া শিক্ষকদের মধ্যেও বিরাজ করছে ক্ষোভ।

রবিবার শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে বিভাগে তালা মেরে শিক্ষকদের আটকে রেখেছেন এমন খবরে দুপুর বেলা বিভাগটিতে গিয়ে দেখা যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবার প্যাকেটজাত করে বিতরণ করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভাগে আটকে পড়া শিক্ষকদের জন্যও একই প্যাকেটের খাবার ভিতরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এই খাবার কোথা থেকে এসেছে তা জানতে চাওয়া হলে শিক্ষার্থীরা তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অনুষদের এক শিক্ষক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “এই আন্দোলনের নাটক মূলত শিক্ষকদেরই পূর্ব-পরিকল্পিত পরিকল্পনার ফসল। শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন বলির পাঠা আর শিক্ষকরা হচ্ছেন এই নাটকের পরিচালক। মূলত শিক্ষকরাই নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করছেন এবং তাদেরকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছেন।”

বিডি-প্রতিদিন/ই-জাহান

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর