শিরোনাম
৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ ১১:৪৮

সিলেট নগরে ইঁদুর-বিড়াল খেলা!

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট

সিলেট নগরে ইঁদুর-বিড়াল খেলা!

ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে সিলেট নগরে। একদিকে সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আর অন্যদিকে নগরের ফুটপাত দখল করে রাখা হকাররা। তাদের মধ্যেই শুরু হয়েছে এই খেলা। মেয়র প্রতিজ্ঞা করেছেন নগর সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন রাখতে ফুটপাত দখল মুক্ত করেই ছাড়বেন।

বিপরীতে ফুটপাত ব্যবসায় জড়িত সুবিধাভোগীরা সবাই একাট্টা, যেকোন মূল্যে মেয়রকে প্রতিহত করবেন তারা। হকারদের পেছনে বড় শক্তি। এ কারণেই প্রতিদিন মেয়র তাড়ান আর ফের বসেন হকাররা। নগরের প্রায় ১০ কিলোমিটার ফুটপাত জুড়ে এখন নিত্যদিনই এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে।

সিলেট নগরের ফুটপাতে হকার সমস্যা দীর্ঘদিনের। নানা উদ্যেগেও সমস্যার সমাধান আসছে না কোনভাবেই। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত হচ্ছে বারবার। একে একে ব্যর্থ হচ্ছেন মেয়র। হার্ড লাইনে গিয়েও কিছু করা যাচ্ছে না। ভেস্তে যাচ্ছে সব পরিকল্পনা। যাচ্ছে তাই অবস্থায় থাকছে সিলেটের ফুটপাত। মেয়র প্রতিদিনই দখলমুক্ত করতে এ্যাকশন চালাচ্ছেন। কিন্তু কোনভাবেই দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। মেয়রের গাড়ি দেখলেই হকাররা দৌড়ে পালান, আর চলে গেলে ফের দখল।

সিলেট নগরের প্রধান এলাকাগুলো বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, রিকাবী বাজার, আম্বরখানা, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট। এসব এলাকায়ই দুপাশে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালান হকাররা। মেয়র আরিফের এই তৎপরতা সত্ত্বেও সরেজমিনে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাত বলে কিছু নেই। মাথার উপর ‘হকার বসা নিষেধ’ এমন নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড নিয়েও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন হকাররা। এমনটি কেন করছেন জিজ্ঞেস করতেই এক হকার নেতার জবাব- ‘আমাদের এক দফা দাবি ‘পুনর্বাসন’। যদি তা না হয়, আমরা রাস্তায় মরবো। কিন্তু ফুটপাত ছাড়বো না’। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হকারদের পেছনে বড় শক্তি রয়েছে সিলেটে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা এবং প্রশাসনের বাণিজ্যে হকাররা শক্ত শেকড়ে অবস্থান নিয়ে আছে সিলেটের ফুটপাতে। নগরজুড়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার ফুটপাতে মাসে কোটি টাকার চাঁদা বাণিজ্য আছে। সিলেটের সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা, পুলিশ এবং হকার নেতাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়রা হয় এই টাকা। যে কারণে হার্ড-লাইনে গিয়েও লাভ হয়নি। বিফল হয়েছে আদালতও। ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর সিলেটর ফুটপাত দখল করে রাখা এমন প্রভাবশলী ১৬ জনকে চিহ্নিত করে তালিকা করেন সিটি মেয়র আরিফ। 

পরবর্তীতে এই ১৬ জনের নাম ছবিসহ তালিকা হস্তান্তর করা হয় আদালতে। তালিকা আদালতে পাঠানোর একমাস পর আটক হন হকার পরিষদের সভাপতি আব্দুর রকিব। কিন্তু কিছুদিন যেতেই জামিনে বের হয়ে আসেন তিনি। কারাগার থেকে বের হয়েই ফের দলবল নিয়ে দখলে নামেন ফুটপাত। সিটি করপোরেশন অভিযান চালালে একদিকবার করপোরেশনের লোকদের ওপর হামলাও হয়েছে। রকিবের নেতৃত্বেই হামলা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘ সময় থেকে হকার নেতা রকিবের নেতৃত্বেই সিলেটে একটি হকার সিন্ডিকেট গড়ে তুলা হয়েছে। বড় শক্তি রয়েছে তাদের পেছনে। যে কারনে হকার দখলমুক্ত হচ্ছে সিলেট নগর। 

নগর মেয়র ফুটপাত দখলমুক্ত করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছেন। যে কারণে দিন রাত কাজ করছেন তিনি। প্রতিদিনই রাস্তায় নামছেন। লাঠি হাতে তাড়িয়ে দিচ্ছেন হকারদের। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ এই পুরনো সমস্যা তাই বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে মেয়রকে। অতীতেও অনেকবার এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়, কিন্তু সমাধান আসেনি। ব্যর্থ হয়েছেন সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন কামরানও। তার সময়ে হকার সমস্যা নগরময় ভোগান্তিতে রূপ নেয়। সে সময়ে একাধিক বৈঠক হয়। নাগরিক কমিটির ব্যানারে কোর্টপয়েন্টে হয় জনসভাও। কিন্তু সমাধানের পথ খুলেনি। 

বরং হকার সমস্যা এমন জট পাকিয়েছিলো যে ২০১২ সালে হকার সমস্যা নিয়ে নাগরিক কমিটি আয়োজিত কোর্টপয়েন্টের জনসভায় কামরান সাফ জানিয়ে দেন হকার সমস্যা সমাধান হবে না, এখানে ‘কিন্তু' আছে। আরিফ ক্ষমতায় এসেই সেই ‘কিন্তু জট’ খোলার চ্যালেঞ্জ ছোড়েন। মেয়রের চেয়ারে বসেই নগরীর ফুটপাত দখলমুক্ত করার উদ্যেগ নেন। লাঠি হাতে তাড়িয়ে বেড়ান হকারদের। প্রথমদিকে হকাররা ফুটপাত ছাড়া শুরু করলেও মেয়র কারান্তরীণ হলে ফের দখল বাড়ে। 

গত ঈদে ফুটপাত দখলের প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করেছে নগরবাসী। এমতাবস্থায় আদালতের নিষেধাজ্ঞাও আসে। এই নিষেধাজ্ঞা পেয়ে ঈদের পরপরই হকার উচ্ছেদে মাঠে নামেন মেয়র। নগরীর দখলকৃত ফুটপাতে ঝুলিয়ে দেন হকার বসা নিষেধ সম্বলিত সাইনবোর্ড। কিন্তু এই সাইনবোর্ড মাথার উপর ঝুলানো রেখেই হকাররা দখলে নেয় ফুটপাত। সর্বশেষ মেয়র আরিফ অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন হকারদের। কোন ভাবেই ফুটপাতে বসতে দেয়া হবে না-এমন কঠিন চ্যালেঞ্জেও পিছু হঠেনি হকাররা। বরং মেয়রকে পাল্টা আল্টিমেটাম দিয়ে বসে তারা। 

‘পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত ফুটপাত ছাড়বো না’ এমন আল্টিমেটাম আসে হকারদের তরফ থেকে। ফুটপাত ছাড়তে মহানগর আদালতের নির্দেশনা আসার পরপরই আন্দোলনে নামেন হকাররা। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান। তারা দাবি জানান- রাজপথ থেকে আদালতের নির্দেশের নাম করে তাদেরকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মানবিক বিবেচনায় এনে হকারদের না তাড়িয়ে দ্রুত পুনর্বাসনের দাবি জানান তারা। 

হকার পুনর্বাসনের চিন্তা মাথায় নিয়ে ২০১৭ সালে নগরের লালদীঘির পাড়ে অবস্থিত একমাত্র হকার মার্কেটটি ভেঙ্গে আধুনিক বহুতল হকার মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা নেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সে লক্ষে গত বছরে সেপ্টেম্বরে পুরনো মার্কেটটি টেন্ডারের মাধ্যমে ভেঙ্গে ফেলা হয়। বর্তমানে এই ভূমিতে আধুনিক বহুতল বভন নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ভবনটি পূনঃনির্মাণ হয়ে গেলে নগরের হকার সমস্যার আর থাকবে না বলে আশা মেয়রের। তবে হকার নেতাদের দাবি নগরীর লালদিঘির হকার মার্কেটে কোন হকারই স্থান পায়নি কোনদিন। দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক হস্তেক্ষেপে। যে কারণে হকাররা কোন উপায় না পেয়ে রাস্তা দখল করে ব্যবসা চালাচ্ছেন। 

এদিকে সিলেটের হকার পরিষদ নেতারা মনে করছেন হকার পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ না নিয়ে ফুটপাতে মেয়রের এমন লাঠি নির্যাতনের সামিল। তাদের দাবি ফুটপাতে ব্যবসা করে প্রায় এক হাজার হকার জীবিকা নির্বাহ করেন। হুট করে তাদের তাড়িয়ে দিলে হকারদের পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। ফুটপাতের হকাররাও বলছেন, তারা পুনর্বাসন চান। আর তা হয়ে গেলেই ফুটপাত পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর