শিরোনাম
২৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০২:৩৪

সিলেটে হাওরের বিষাক্ত মাছ বাজারে, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

ব্যুরো অফিস, সিলেট

সিলেটে হাওরের বিষাক্ত মাছ বাজারে, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

আকস্মিক বন্যায় সিলেটের হাকালুকি হাওর ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এতে টানা কয়েকদিন পানিতে তলিয়ে থাকা কাঁচা ও আধপাকা ধান পচে গিয়ে পানিতে হাইড্রোজেন সালফাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কমে গেছে অক্সিজেন। ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে মারা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিষাক্ত এসব মরা মাছ খেয়ে মারা যাচ্ছে হাঁসও। কিন্তু একশ্রেণীর অসাধু লোকজন মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর এসব বিষাক্ত মাছ গোপনে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করছে। সেসব মাছ যাচ্ছে হোটেল-রেস্টুরেন্টেও। এমনকি রাতের আঁধারে এসব মাছ ঢাকায়ও পাঠানো হচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে বিস্তীর্ণ হাকালুকি হাওর মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। এ হাওর থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিকটন মাছ আহরণ করা হয়। সুনামগঞ্জে রয়েছে দেখার হাওর, বরাম হাওর, হাইল হাওর, নলওয়ার হাওর, মৈইয়ার হাওর, থাল হাওর, খরচার হাওর, মাটিয়ান হাওরের মতো বড় বড় হাওরসহ শতাধিক হাওর। কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এসব হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যায়। সুনামগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে হু হু করে পানি ঢুকে হাওরগুলোতে। হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণে গাফিলতি ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তার তদন্ত করছে দুদক।

একটানা কয়েকদিন পানির নিচে তলিয়ে থাকায় কাঁচা ও আধপাকা বোরো ফসল পচে বিষাক্ত হয়ে পড়ে হাওরের পানি। পানিতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় হাইড্রোজেন সালফাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা। বিপরীতে অস্বাভাবিকভাবে কমে আসে অক্সিজেনের মাত্রা, কমে যায় পানির অ্যাসিটিক ও ক্ষারীয়ভাব। এছাড়া, ধানে ছিটানো কীটনাশক ও রাসায়নিকও ছড়িয়ে পড়ে হাওরজুড়ে। ফলে ভয়ঙ্করভাবে বিষাক্ত হয়ে পড়ে হাওরের পানি। মরতে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির টন টন মাছ। এসব মাছ খাওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করছেন চিকিৎসকরা। এমনকি এসব মাছ খেলে মানবদেহে টক্সিনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে পারে বলে হুশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কতিপয় অসাধু লোকজন এসব বিষাক্ত মাছ কৌশলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করছে। এতে জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে।

সূত্র জানায়, সিলেটের হাকালুকি হাওর এলাকা এবং সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর এলাকার কতিপয় লোকজন বিষাক্ত মাছ ধরে বরফের আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেয়। এতে করে বিষাক্ত মাছ ও স্বাভাবিক মাছের তফাত বুঝা যায় না। বরফে মোড়া বিষাক্ত মাছ সড়ক ও নদীপথে সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে আসছে মাছ পাইকাররা। সেসব মাছ স্বাভাবিক মাছ হিসেবেই বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে হোটেল, রেস্টুরেন্টগুলোতে। এমনকি, রাতের আঁধারে যেসব বাস সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাচ্ছে, সেগুলোর ছাদে করে এসব বিষাক্ত মাছ ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। সুনামগঞ্জের হাওরে বিষাক্ত মাছ না ধরতে জেলা প্রশাসন এক সপ্তাহের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিলেও তা মানছে না অসাধু লোকজন। ফলে হোটেল, রেস্তোরাঁয় এসব বিষাক্ত মাছ খেয়ে বিপদ ডেকে আনছেন সাধারণ মানুষ।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) মাইক্রোবায়োলাজি এন্ড ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান ড. মাহবুব-ই-এলাহী বলেন, ‘হাওরের পানি ও বাতাস দূষিত হয়ে পড়েছে। অ্যামেনিয়া গ্যাসের প্রভাবে মারা পড়ছে মাছ। এসব মাছ খেলে মানবদেহে টক্সিনের পরিমাণ বেড়ে মানুষ মারাও যেতে পারে।’

সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফসল পচে গিয়ে পানিতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিষক্রিয়ার ফলে যে সব মাছ ভেসে ওঠছে সেগুলো খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।’ তিনি আরো বলেন, ‘হাওরের দূষিত পানি ব্যবহার থেকেও জনসাধারণকে বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট ছাড়াও মানবদেহে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে।’ দৈনন্দিক কাজে প্রয়োজনে পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।

এদিকে, হাওরের পানি দূষিত হওয়ার কারণ নির্ণয়ে গত শুক্রবার সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনধি দল। ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক মাসুদ উদ্দিন খান বলেন, ‘ধান পচে হাওরের পানিতে হাইড্রোজেন সালফাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। সেই সাথে পানির অ্যাসিটিক ও ক্ষারীয়ভাব অনেক কমে আসায় মাছ মরে ভেসে ওঠছে।’ তিনি জানান, ধানক্ষেত্রে কীটনাশক ও রায়ায়নিক সারের ব্যবহারও পানি দূষিত হওয়ার অন্যতম কারণ।

মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, মাছের স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য পানিতে ৫-৭ পিপিএম অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কোন কোন হাওরে পানি দূষিত হয়ে ২-৪ পিপিএম অক্সিজেন রয়েছে। এর বিপরীতে মাছের জন্য ক্ষতিকারক অ্যামোনিয়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিতে এর পরিমাণ দশমিক ২ পিপিএম থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কোন কোন হাওরে তা দশমিক ৯ থেকে ১ দশমিক ২ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মাছের স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য খুবই প্রতিকূল। এদিকে, হাওরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে চুন ছিটানো হচ্ছে। এতে পানির দূষিতভাব কমে গিয়ে বাড়বে অক্সিজেন।

সিলেট বিভাগীয় প্রাণী সম্পদ অফিসের উপ-পরিচালক ড. মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, হাওরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে প্রচুর পরিমাণে চুন ছিটানো হচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে হাওরের পানি।

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস কর্মকর্তা শঙ্কর রঞ্জন দাশ বলেন, ‘মাছের বেঁচে থাকার অনূকুল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হাওরে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে চুন ফেলা হচ্ছে। এতে করে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়বে এবং ক্ষতিকারণ অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের পরিমাণ কমে আসবে।’


বিডি-প্রতিদিন/২৩ এপ্রিল, ২০১৭/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর