১৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০৯:০০
রাজশাহীতে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি - ৫

পাহাড়সম অভিযোগ এমপি দারার বিরুদ্ধে

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

পাহাড়সম অভিযোগ এমপি দারার বিরুদ্ধে

রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ। সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুকের উপস্থিতিতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মজিদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক মুনসুর রহমান ও দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন। তাদের মধ্যে তাজুল ইসলাম ফারুকসহ প্রথম তিনজন আগামী সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন দলীয় প্রত্যাশী। সমাবেশে অভিযোগ করা হয়, দারা পুঠিয়া ও দুর্গাপুরে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছেন। তবে এমপি দারা বলেছেন, ‘যারা আমার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে উপকৃত হয়েছে, তারাই আজ আমার বিরুদ্ধে নেমেছে। তাদের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীরা নেই। নেতা-কর্মীরা আমার সঙ্গে আছে।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাজুল ফারুককে বাদ দিয়ে রাজশাহী-৫ আসনে মনোনয়ন পান ব্যবসায়ী কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। তিনি বিজয়ী হন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে উঠতে থাকে নানা অভিযোগ। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কিশমতগণকৈড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আফসার আলী জানান, আবদুল জব্বার এক সময় শিবির করত, পরে জামায়াত। ২০০৪ সালে জেএমবিতে যোগ দিয়ে বাংলা ভাইয়ের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন, যা দুর্গাপুরের মানুষ জানে। টাকা নিয়ে তাকে কিশোরপুর মাদ্রাসার সুপার পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনো জামায়াতের সঙ্গে জড়িত। তারপরও এমপি তাকেই চাকরিটা দিল। রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের এমপি কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা সম্পর্কে তার দলের লোকের ও এলাকাবাসীর প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, নিয়োগ, স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ বা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য টাকা নেওয়া, ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি, টাকার লেনদেন, জামায়াত-বিএনপির লোকদের আওয়ামী লীগে এনে স্থানীয় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়া ইত্যাদি।  এসব অভিযোগ দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিতভাবে পাঠিয়েছেন স্থানীয় নেতারা। গত বছরে ৭ মে দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র তোফাজ্জল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কিশমতগণকৈড় ইউপি চেয়ারম্যান আফসার আলী মোল্লা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বানেছা বেগম, ভাইস চেয়ারম্যান জামাল উদ্দীন, পানানগর ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আজাহার আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ও দেলুয়াবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম, জয়নগর ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সমশের আলী  প্রধানমন্ত্রীর কাছে দারার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন। ওই অভিযোগে বলা হয়, এমপি দারা দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ২০৮ জনকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এই শিক্ষকদের মধ্যে জেএমবির ৫ সদস্য, জামায়াতে ইসলামীর ১৫ এবং বিএনপির ৫৮ জন আছেন। উপজেলা সদরের কলেজকে বাদ দিয়ে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরের দাউকান্দি কলেজকে জাতীয়করণ করেছেন এমপি। এজন্য তিনি ৭০ লাখ টাকা নিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এমপি দারা যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের নানান সুবিধা দিতে থাকেন। ২০১২ সালের ১৩ মে এমপি দুর্গাপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আলম হিরু মাস্টারের ছেলে বাকীউল আলম লিটনকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দুর্গাপুরের রাজাকার আবদুল ওয়াহেদ মোল্লার পক্ষে ডিও লেটার দিয়ে মাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি বানান। এরপর রাজাকার ওয়াহেদ মোল্লার ছেলে শরীরচর্চার শিক্ষক সুমন মোল্লাকে নীতিমালা ভঙ্গ করে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করেন।

এমপি কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা বলেন, ‘জব্বারকে চাকরি দিয়েছিলাম আফসার মোল্লা আর মেয়র তোফাজ্জলের কথায়। তারাই সুপারিশ করেছিল। আমি তাকে চিনতামও না।’

পুঠিয়ার সাধনপুরের পঙ্গু শিশু নিকেতন সমন্বিত অবৈতনিক ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, লস্করপুর কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, সরিষাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগে এমপির অনুগত দলীয় লোকেরা ২৫ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। নিয়োগের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যুবলীগের সংঘর্ষ হয়। এমপি দারার উত্সাহে বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতাদের আওয়ামী লীগে যোগদান বেড়ে গেছে। গত বছরের ২৪ মার্চ পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুল লতিফ বিশ্বাস ও পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আলী হোসেনকে ফুলের মালা পরিয়ে আওয়ামী লীগে বরণ করে নেন এমপি। এর আগে পুঠিয়া উপজেলা জামায়াতের রোকন আরিফ হোসেনকে ২০১৪ সালে দলে নিয়েই তাকে জিউপাড়া ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি করেন এমপি। থানা জামায়াতের সদস্য মজিবর রহমানকে করেছেন সাধারণ সম্পাদক। জামায়াত নেতা কাদের আলীকে দিয়েছেন প্রচার সম্পাদকের পদ। শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি শুকুর আলী সরদারকে শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ বলেন, এমপি দারা সংগঠনে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে এনে নিজ দলের পুরনো নেতা-কর্মীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগকে পকেট কমিটিতে পরিণত করেছেন। এমপি নিজে সভাপতি এবং তার স্ত্রী, ভাই ও চাচাকে উপজেলা আওয়ামী লীগে বিভিন্ন পদ দিয়েছেন। এমপি নিজে ঢাকায় থাকেন। দলের কোনো সাংগঠনিক তত্পরতা নেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ ও অন্যসব অভিযোগের বিষয়ে আবদুল ওয়াদুদ দারা বলেন, ‘এলাকার কিছু সুবিধাবাদী লোক আছে। যারা আমার কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছে। এখন তারাই ষড়যন্ত্র করছে। তারা দলের ভিতরে থেকে ষড়যন্ত্র করছে। এদের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরে সংগঠন থেকে বের করে দেওয়া উচিত।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর