রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতা মিলে চাঁদাবাজির বেপরোয়া সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। গত দেড় দশকে টার্মিনালকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে পালিয়েছেন পরিবহন চঁাঁদাবাজরা। বাস মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশনের নাম ভাঙিয়ে গত ১৫ বছর যারা মাস্তানি, চাঁদাবাজিতে টার্মিনাল অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন তাঁদের অপকর্ম সামনে আসতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে বাস মালিক সমিতির চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ, সেক্রেটারি আবু রায়হান, শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্বাস উদ্দিন, শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি মফিজুল হক বেবুসহ অন্যরা গাবতলীকে চাঁদার খনি বানিয়েছিলেন। উত্তরের ১৬ জেলা এবং দক্ষিণের ২১ জেলার বাস চলাচল করে এ টার্মিনাল ব্যবহার করে। এ ৩৭ জেলার অন্তত ১ হাজার ৮০০ বাসকে প্রতিদিন প্রতি ট্রিপে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে গাবতলী ছাড়তে হতো। নেতাদের নামে গত অর্ধযুগে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে পরিবহনসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র জানান, গাবতলী টার্মিনাল ব্যবহার করে ১২০টি কাউন্টারের মাধ্যমে ৩৭ জেলায় প্রায় ৯০০ বাস চলাচল করে। এর বাইরে ঢাকা-পাটুরিয়া রুটে সেলফি পরিবহন নামে একটি সার্ভিসের কয়েক শ বাস চলে। গাবতলী থেকে সাটুরিয়া-ঘিওর-মানিকগঞ্জ রুটের যানবাহন মালিকদের রয়েছে বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ। তাদেরও রয়েছে ৩ শতাধিক বাস। ঢাকা-নবীনগর রুটেও আছে আলাদা কমিটি। এ ছাড়া ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটেও গাবতলী থেকে কিছু বাস চলে। প্রতিটি বাসকেই নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া গাবতলীর অদূরে মিরপুর ১ নম্বরে শাহ আলী মাজারের সামনে প্রতি রাতে ২ শতাধিক সবজির ট্রাক আসে। সেখান থেকেও চাঁদা তোলা হয়। পরিবহন মালিকরা জানান, ক্ষেত্রভেদে প্রতিটি গাড়িকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হতো। এমনকি যেসব বাস টার্মিনাল ব্যবহার করত না সেগুলোকেও চাঁদা দিতে হতো। ভুক্তভোগীরা জানান, বিভিন্ন খাতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদা উঠত গাবতলী টার্মিনাল কেন্দ্র করে। ৫ আগস্টের পর সেই চিহ্নিত চাঁদাবাজরা পালিয়েছেন।
সূত্র জানান, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের পরিচালন ব্যয় হিসেবে নির্ধারিত হারে চাঁদা তোলার বৈধতা থাকলেও কয়েক গুণ বেশি টাকা তোলা হতো। টার্মিনালের কাউন্টার থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০, শ্রমিক ফেডারেশন ১০, কমিউনিটি পুলিশ ১০, মালিক সমিতি ৪০- এ ১০০ টাকা চাঁদা তোলার কথা। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পার্কিং ফি ৫০ টাকা। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি আবু রায়হানের কালে কত টাকা চাঁদা তোলা হতো তার কোনো হিসাব নেই। নির্ধারিত হারের কয়েক গুণ টাকা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিজের পকেটে অ্যাসোসিয়েশনের টাকা : ২০১৯ সালের পর থেকে অ্যাসোসিয়েশনের টাকা আদায়ের কোনো ডকুমেন্ট রাখা হয়নি। এর আগে প্রতিদিন মালিক সমিতির নিয়োজিত কর্মচারীরা টাকা তুলতেন। অ্যাসোসিয়েশন সে টাকা প্রতিদিনই ব্যাংকে জমা দিত। আবু রায়হান সেক্রেটারি হওয়ার পর টাকা তুলতেন নিজের লোক দিয়ে। ফারুক, ফয়সাল, সুমনসহ কয়েকজন তাদের ইচ্ছামতো টাকা তুলে দিতেন রায়হান সাহেবের কাছে। মাসে একবার সে টাকার একটা অংশ সমিতির অ্যাকাউন্টে জমা হতো। সমিতির কাছে গত ছয় বছরের টাকা তোলার কোনো হিসাব নেই। কোনো রুটে নতুন গাড়ি নামাতে আড়াই লাখ টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে মালিক সমিতির ২ লাখ ২০ হাজার এবং শ্রমিক ইউনিয়নের ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শীর্ষ পরিবহন কোম্পানিগুলো মাসিক ভিত্তিতে অ্যাসোসিয়েশনকে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা অনুদান দেয়। এর মধ্যে রয়েছে হানিফ ৩০ হাজার, শ্যামলী (এসপি) ১৫ হাজার, শ্যামলী (এনপি) ১৫ হাজার, সোহাগ ১২ হাজার, এসআর ১২ হাজার, সাকুরা ৭ হাজার, আলহামরা ৭ হাজার, নাবিল ৬ হাজার, দেশ ট্রাভেলস ২০ হাজার, দিগন্ত ৮ হাজারসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি। এ ছাড়া জিএম সিরাজের নেতৃত্বকালে তৈরি অ্যাসোসিয়েশনের কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন অফিস ভবন থেকে মাসে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা ভাড়া আসে সমিতির ফান্ডে। রমেশ-রায়হানদের গত ছয় বছরের নেতৃত্বকালে সমিতিতে কোনো সম্পদ যোগ হয়নি, বরং ফান্ডের টাকা ব্যাপকহারে লুট হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের টাকা হরিলুট : নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকা এমনকি ব্যক্তিগত খাতেও ব্যয় হয়েছে অ্যাসোসিয়েশনের টাকা। ঢাকা-১৪ আসনের ছয় মাসের এমপি মাইনুল হোসেন খান নিখিল নির্বাচনে জিতে গত ১৬ জানুয়ারি টুঙ্গিপাড়া যান। এজন্য ২৯টি গাড়ির লাইন খরচ বাবদ অ্যাসোসিয়েশন থেকে দেওয়া হয় ১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে বাস টার্মিনালসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাকে আপ্যায়নের নামে ১ আগস্ট আইএফআইসি ব্যাংকের একটি চেকের মাধ্যমে দেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের ছেলের উপজেলা নির্বাচনের জন্য ২ লাখ টাকা দেওয়া হয় ৭ মে আইএফআইসি ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে। ট্রেজারার গোলাম কবির অ্যাসোসিয়েশন থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নেন। অ্যাসোসিয়েশনের অফিস সাজাতে ১০ লাখ টাকা নেন সংগঠনের চেয়ারম্যান রমেশ ঘোষ। কিন্তু অফিস সাজানো হয়নি, টাকাও ফেরত আসেনি।
একই চক্র নেতৃত্বে অর্ধযুগ : টার্মিনালে নৈরাজ্যের মূল হোতা বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল আবু রায়হান পলাতক। আওয়ামী লীগের আমলে সেই ১৯৯৬ সাল থেকে সুবিধা পাওয়া শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রমেশ চন্দ্র ঘোষ এখনো নেতৃত্বে আছেন। গাবতলীকেন্দ্রিক বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান তিনি। তাঁর নেতৃত্বে গত কয়েক মেয়াদে অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল রোজিনা এন্টারপ্রাইজের আবু রায়হান এবং ট্রেজারার কে লাইন পরিবহনের ইঞ্জিনিয়ার গোলাম কবির। এ ত্রিরত্ন ২০১৯-২০২১ মেয়াদে শীর্ষ তিনটি পদ চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি ও ট্রেজারার ছিলেন। পরবর্তী ২০২১-২০২৩ মেয়াদেও তাঁরা একই পদে ছিলেন। চলতি ২০২৩-২০২৫ মেয়দেও তাঁরাই এ তিন পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সেক্রেটারি জেনারেল আবু রায়হান পালানোর পর এ পদে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পেয়েছেন শ্যামলী পরিবহনের (এনআর) স্বত্বাধিকারী শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ। তিনি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ ঘোষের ভাতিজা। রমেশ ঘোষের শ্যামলী পরিবহন ১৯৯৯ সালের ১৯ জুন ঢাকা-কলকাতা আন্তর্জাতিক বাস সার্ভিস চালুর দায়িত্ব পায়। ২০১৫ সালের ৬ জুন ঢাকা-আগরতলা রুটেও বাস চলাচলের দায়িত্ব পান তিনি। এর আগে ২০১৪ সালে ঢাকা-গুয়াহাটি রুটের বাসও অপারেট করে ভাতিজার প্রতিষ্ঠান শ্যামলী পরিবহন।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন : গাবতলীর পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, টার্মিনাল এবং মালিক-শ্রমিকদের নেতৃত্ব কারা দেবেন তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে স্বৈরাচারের সময় টার্মিনালের বাইরে ছিলেন এমন নেতারা এখন ফিরে আসছেন। আগামী ২৩ নভেম্বর বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হবে। এর মধ্য দিয়ে সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জনপ্রিয় পরিবহন এস আর ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান বগুড়ার পাঁচবারের এমপি বিএনপি নেতা জি এম সিরাজ একসময় বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি আবারও নেতৃত্বে ফিরতে পারেন বলে মালিকদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। তবে জি এম সিরাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি চারবার এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলাম। স্বচ্ছতার সঙ্গে সংগঠন চালিয়েছি। আর নয়। এখন নতুন নেতৃত্ব আসা দরকার।’
স্থানীয়রা জানান, গাবতলী টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন হানিফ পরিবহনের মালিক ও আমিনবাজারের বিএনপি নেতা কফিল উদ্দিনের লোকজন। তবে তিনি বলেন, ‘আমি টার্মিনাল বা মালিক সমিতি দখল করিনি। আমি শুধু গাবতলীতে চাঁদাবাজি বন্ধ করে দিয়েছি।’ কফিল উদ্দিন বলেন, ‘গত ১৫ বছর আমরা ব্যবসা করতে পারিনি। সমিতি করতে গেলে সময় দিতে হয়। এত সময় আমার নাই। আমি বলেছি আর কাউকে চাঁদা নিতে দেব না। চাঁদা নিতে চাইলে প্রতিহত করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাবতলী টার্মিনালে আমি যাই না। এর মধ্যে মাত্র এক দিন গিয়েছিলাম। সেদিন গিয়েই চাঁদা বন্ধ করেছি।’ মালিক সমিতির নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আর নেতৃত্ব দিতে চাই না। তখন অন্য কেউ চাঁদাবাজি করলেও তার বদনাম আসবে আমার ঘাড়ে। আমি সেটা চাই না। দল (বিএনপি) করার কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আমি নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে চাই।’
খালেক এন্টরপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এস এ সিদ্দিক সাজু বলেন, ‘গত ১৫ বছরে গাবতলী টার্মিালকেন্দ্রিক ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়েছে। সে টাকা ব্যক্তিগত ও দলীয় কাজে ব্যবহার হয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মালিকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আগামী মাসে অ্যাসোসিয়েশনের এজিএম আছে। সেখানে এসব বিষয় উঠে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি অনুপস্থিত, সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। মূলত সিটি করপোরেশনের টার্মিনাল, তারাই চালাচ্ছে। আমরা সহায়তা করছি যাতে যানজট না হয়। সব গাড়ি যাতে সারিবদ্ধভাবে চলে।’ অ্যাসোসিয়েশনের নতুন নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নিজের ব্যবসায়ও সময় দিতে হয়। ফলে সংগঠনে সময় দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। তার পরও সাধারণ মালিকদের ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক যা চাইবেন সেভাবেই হবে।’
উল্লেখ্য, মিরপুরের (ঢাকা-১৪) প্রয়াত এমপি আসলামুল হক দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করতেন গাবতলী টার্মিনাল। এ সময় তাঁর লোকজন পরিবহন থেকে বেপরোয়া চাঁদা তুলতেন। আসলামের ভাই মফিজুল হক বেবু তখন গাবতলী টার্মিনালে অত্যন্ত দাপুটে হয়ে ওঠেন। তাঁর নিজের কোনো পরিবহন ব্যবসা না থাকলেও শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হিসেবে মালিক সমিতিতে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। এমনকি ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল আসলামুল হক মারা গেলেও মফিজুল হক বেবুর প্রভাব কমেনি। পরবর্তী এমপি আগা খান মিন্টুকে সামনে রেখে চাঁদাবাজির তা ব চালান বেবু। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকা-১৪ আসনের এমপি হন মাইনুল হোসেন খান নিখিল। তিনি টার্মিনালের নতুন গডফাদার হয়ে ওঠেন। সেই বেবু এখন পলাতক। একইভাবে গাবতলীর নেতা ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্বাস উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক দ্বীন মোহাম্মদ বুলু, দপ্তর সম্পাদক আশরাফ আলীসহ আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবহন শ্রমিক নেতারা পলাতক। নিখিল এমপি হওয়ার পর শ্রমিকনেতা আব্বাস, বেবু মালিক সমিতির নেতৃত্বেও প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁরা অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি আবু রায়হানের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।