৭ আগস্ট, ২০১৮ ০৮:৩১

ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট ক্লোনিং

মির্জা মেহেদী তমাল

ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট ক্লোনিং

‘বড় ভাই, আমার খুব বিপদ। ৪ হাজার টাকা লাগবে, এক্ষুনি। পাঠাতে পারবেন? আমার মোবাইলেও ব্যালান্স নেই। তাই আপনাকে ফোন করতে পারছি না।’

ফেসবুকের মেসেঞ্জার ইনবক্সে হঠাৎ কাঁকনের এমন ‘জরুরি’ বার্তা চোখে পড়ে তার এক খালাতো ভাইয়ের। শান্ত-শিষ্ট ও ভদ্র সেই ছোট ভাইয়ের বার্তা পেয়ে বড় ভাই ভাবেন, নিশ্চয়ই বিশেষ প্রয়োজনে টাকা দরকার পড়েছে কাঁকনের। আশপাশে হয়তো কোনো ব্যাংকের বুথও নেই। সাতপাঁচ না ভেবেই তার পাঠানো বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। পরদিন কাঁকন ফোন করেন তার সেই ভাইকে। জিজ্ঞাসা করেন তার বিপদ কেটেছে কিনা। তখন ভাই বলেন তিনি বিপদে পড়বেন কেন! তিনি তো সারা দিন ঢাকায় ব্যস্ত ছিলেন একটি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। পরে উভয়েই বুঝতে পারেন ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। এক পর্যায়ে অনেক কষ্টে তার হ্যাক হয়ে যাওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি রক্ষা করেন। পরে পোস্টে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেন। জানতে পারেন, ইতোমধ্যে ভাইয়ের নামে ৮-১০ জনের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু কাঁকন নন, ফেসবুক-বিকাশের মাধ্যমে এভাবে প্রতিদিন নিত্যনতুন প্রতারণার জালে পা দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। না বুঝে প্রতারকদের টোপে নিঃস্ব হচ্ছেন বিকাশ গ্রাহক কিংবা সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেসবুক হ্যাক করার পর আইডির প্রকৃত মালিকের কাছেও টাকা দাবি করছে ডিজিটাল অপরাধীরা। টাকা দিলে ফেরত দেওয়া হয় আইডি। প্রতিদিনই এ রকম অভিযোগ আসছে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে। তবে যে হারে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে, সে হারে মামলা হচ্ছে না। অর্থাৎ মানুষ ঝামেলা এড়াতে পুলিশের কাছে যায় না। তাই ডিজিটাল এই প্রতারণার জাল কতদূর গড়িয়েছে সে বিষয়ে অনেকটাই অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ডিজিটাল এসব ফাঁদ প্রতিরোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই ঘটে চলেছে একের পর প্রতারণার ঘটনা। ফেসবুকে বন্ধু পাতিয়ে চলেছে প্রতারণা। কখনো শারীরিক সম্পর্কের টোপ দেওয়া হচ্ছে, কখনো নিখুঁত প্রেমের গল্প বানিয়ে চলছে দেদার প্রতারণা। সাধু বাবা, জিনের বাদশাহ সেজে কিংবা বিকাশ অফিসের কর্মকর্তা সেজে এমন ডিজিটাল সাইবার প্রতারণা চক্রের খপ্পরে পড়ে হাজার হাজার টাকা খুইয়েছে অনেকে। গাড়ি-বাড়ির লোভ দেখিয়েও সর্বস্বান্ত করছে সহজসরল মানুষকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফার্মগেটের এক ব্যবসায়ীর কাছে মোবাইল কোম্পানির কর্মকর্তা সেজে কল দিয়ে তাকে দামি প্রাইভেট কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ৭-৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবার প্রযুক্তির এই প্রতারণার ফলে অনেকেরই সংসারে ভাঙন লেগেছে।

মানিকগঞ্জের আবদুস সাত্তার নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ওই আইডি থেকে কমপক্ষে ৫০ জন ফ্রেন্ডের কাছে একটি নম্বরে বিকাশে টাকা চেয়েছে হ্যাকাররা। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নতুন নতুন কৌশলে অন্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণির হ্যাকার। যে কারণে ফেসবুক এখন চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি তথ্য-পরিচয় চুরি করার নতুন একটি কৌশল (স্ক্যাম) ফেসবুকে ছড়িয়েছে। প্রতারণার এ কৌশলকে বলা হচ্ছে ‘অ্যাকাউন্ট ক্লোনিং’। এর মাধ্যমে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিতে ব্যবহারকারীর নাম ও প্রোফাইলের ছবি কপি বা নকল করে নতুন একটি অ্যাকাউন্ট খোলে দুর্বৃত্তরা। ওই অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আসল অ্যাকাউন্টের পার্থক্য সহজে ধরা যায় না। অ্যাকাউন্ট তৈরির পর ব্যবহারকারীর ছদ্মবেশে বন্ধু ও পরিবারের লোকজনকে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ (ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট) জানায়। এমনকি ফেসবুকে চ্যাটও শুরু করে। এক পর্যায়ে অর্থ চেয়ে বসে। এমনকি ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগের সময় বিভিন্ন লিঙ্ক শেয়ার করে অন্যদের সঙ্গে তা শেয়ার করতে বলে। এভাবে একজনের প্রোফাইল থেকে আরেক প্রোফাইলে এ স্ক্যাম ছড়ায়। তা ছাড়া ফেসবুক যোগাযোগে নানারকম প্রলোভনও দেখানো হয়। এমনি প্রতারণার শিকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম মাহবুব আলম জানান, তার পরিচিত একজন ফেসবুক বন্ধুর আইডি থেকে তার কাছে ৫ হাজার টাকা চাওয়া হয় যা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ তার এই বন্ধু কখনো তার কাছে এভাবে টাকা চাননি। তিনি বলেন, ‘টাকা চাওয়ার সময় আমার ওই বন্ধুকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু তখন তাকে পাওয়া যায়নি। তবে অবশ্যই এটা প্রতারণা। কারণ আমার বন্ধু (ফেসবুক) আমার কাছে এভাবে কখনো টাকা চাননি।’

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, যারা এ ধরনের প্রতারণার আশঙ্কা করছেন, তারা অবশ্যই ফেসবুক প্রোফাইলটি আসল কিনা, তা যাচাই করে দেখবেন। কারও বন্ধু হয়ে থাকা অবস্থায় তার অ্যাকাউন্ট থেকে আবারও অনুরোধ পেলে তা আসল কিনা, তা যোগাযোগ করে জেনে নিতে হবে। এদিকে, যুক্তরাজ্যের সানডে এক্সপ্রেসের এক খবরে বলা হয়েছে, ফেসবুকে এ ধরনের স্ক্যাম বর্তমানে বেড়ে গেছে। এর মাধ্যমে ফেসবুকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের লটারি জেতার খবর প্রচার করার অনুরোধ অনেকের কাছে আসছে বলেও অভিযোগ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে ফেসবুকে পাঁচটি বিষয় শেয়ার না করলে অ্যাকাউন্ট ক্লোন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তা হলো— ফেসবুকে বাড়ির ঠিকানা না দেওয়া। পাসওয়ার্ড কাউকে না জানানো। অসংগত ছবি শেয়ার না করা। বর্তমান অবস্থান ও সম্পর্ক গোপন রাখা। জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান গোপন রাখা। তা ছাড়া অবশ্যই পুলিশকে খবর দিতে হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর