শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

হরিহর নদীর তীরে একই কবরে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা

ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির স্পেশাল অফিসার ছিলেন মাশফিকুর রহমান তোজো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অফিসের গাড়িটি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে সেখানে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ, কংগ্রেস ও সিপিএম নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। এক পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য নিজের অফিসের গাড়িটি তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে ফিরে আসেন দেশে। মেধাবী যুবক তোজো ১৯৬১ সালে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি এবং '৬২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। '৬৩ সালে অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একচুয়ারিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। '৬৯ সালে দেশে ফিরে কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের নেতা ও যশোর এমএম কলেজের ভিপি। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। সিরাজুল ইসলাম শান্তি ছিলেন জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। আহসান উদ্দিন খান মানিক ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের জেলা সভাপতি। আরেকজনের নাম ফজলু। অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পরে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হলে সেনাবাহিনী ছেড়ে গ্রামে এসে কমিউনিস্ট পার্টি সিপিইপিতে (এমএল) যোগ দেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সঙ্গে এ পাঁচ বন্ধুরই ছিল নিবিড় সম্পর্ক।

মুক্তিযুদ্ধকালে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের জন্য বসে না থেকে দলটির যশোর ও খুলনা জেলা কমিটি পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার পুলুম ও খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায় ঘাঁটিও গড়ে তোলা হয়। পার্টির নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গড়ে তোলা হয় গেরিলা বাহিনী। যুদ্ধের শুরুতেই বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি লুট করে অস্ত্র সংগ্রহের পর সেগুলো নিয়েই পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন তারা। যশোর ও খুলনার বেশকিছু এলাকা শত্রুমুক্তও করেন। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পাঁচ বন্ধু- তোজো, আসাদ, শান্তি, মানিক ও ফজলু। '৭১-এর আগস্টে কমিউনিস্ট পার্টির পুলুম ঘাঁটি ভেঙে গেলে কর্মীরা ডুমুরিয়ায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নিরস্ত্র পাঁচ বন্ধু বেরিয়ে পড়েন যশোরের দিকে। পথে রাত হলে তারা মনিরামপুর উপজেলার স্বরপুর গ্রামের আবদুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। টের পেয়ে যান পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আবদুল মালেক ডাক্তারের নেতৃত্বে মেহের জল্লাদ, ইসাহাক, আবদুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। তারা চোখ বেঁধে ওই পাঁচ সূর্যসন্তানকে নিয়ে যান পাশের চিনেটোলা বাজারের পুব পাশে হরিহর নদের তীরে। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। বেয়নেট দিয়ে তাদের শরীরের নানা জায়গা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেখানে লবণ দেওয়া হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় রাত ৮টার দিকে তাদের ব্রিজের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজাকারদের ভয়ে সে সময় কেউ এগিয়ে যায়নি। সকালে ওই গ্রামের শ্যামাপদ ও আকব্বর আলী ঘটনাস্থলে একটি কবর খুঁড়ে একই কবরে পাঁচ শহীদের লাশ দাফন করেন।

আজ ২৩ অক্টোবর তোজো, আসাদ, শান্তি, মানিক ও ফজলুর ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকী। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, রাজাকাররা যেখানে এই পাঁচ মুক্তিকামীকে হত্যা করেছিলেন, স্থানীয় উদ্যোগে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হলেও তা অসম্পূর্ণ। এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে এলেও পাঁচ শহীদের স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো কিছুই করা হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর