সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভাড়ায় চার্ট মানছেন না বাস মালিকরা

আহমদ সেলিম রেজা

বাস ও মিনিবাসের ভাড়া সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৫ থেকে ৭ টাকা হলেও এ চার্ট মানছেন না বাস মালিকরা। তারা নানা অজুহাতে অঘোষিতভাবে ভাড়া বাড়িয়ে যাত্রী সাধারণের পকেট কাটছেন। সরকারি হিসাবে আগে কিলোমিটারে ১০ পয়সা হারে ভাড়া বাড়নো হতো। এবার বাড়ানো হয়েছে স্টপেজ হিসেবে। সর্বনিম্ন ২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। যদিও সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ থেকে ৭ টাকা। এক্ষেত্রে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা। ভিআইপি গেটলকে ফার্মগেট থেকে খিলক্ষেত যেতে গুণতে হচ্ছে ৫০ টাকা। যদিও সরকার ভাড়া বৃদ্ধির কোনো ঘোষণা দেয়নি। একতরফাভাবেই পরিবহন মালিকদের নির্দেশে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাসের ড্রাইভার ও কন্ডাক্টররা জানান, রাজধানীতে চলাচলকারী প্রতিটি রুটে গত ৭ মার্চ থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে ১ মার্চ থেকে। যাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৭ মার্চ থেকে।  তবে লাব্বায়েকসহ কিছু পরিবহন কোম্পানি গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। এজন্য বিভিন্ন বাসে কন্ডাক্টরদের কাছে বর্ধিত ভাড়ার চার্টও দেওয়া হয়েছে। তাতে সরকারি কোনো দফতরের সিল স্বাক্ষর নেই। সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির সিল স্বাক্ষরযুক্ত ওই ভাড়ার চার্টে দেখা যায়, মালিকরা নির্ধারিত কিছু স্টপেজ ধরে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মধ্যবর্তী যাত্রীরা নির্ধারিত সেই স্টপেজ থেকে বাসে ওঠা-নামা না করলেও মালিক নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। জানা গেছে, এ নিয়ে প্রতিনিয়তই বাস কন্ডাক্টারদের সঙ্গে চলছে যাত্রীদের বচসা । যাত্রী লাঞ্ছনার মতো অঘটনও ঘটছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচল করা বাসের যাত্রীপ্রতি ভাড়া বাড়ে প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা হারে। সে অনুযায়ী ৫২ সিটের বড় বাসে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নির্ধারিত হয় ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং ৩০ সিটের মিনিবাসে ভাড়া নির্ধারিত হয় ১ টাকা ৬০ পয়সা হারে। তখন সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় বড় বাসে জনপ্রতি ৭ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকা।

 এ বিষয়ে সরকার ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর সরকার বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়ায়নি। অথচ এরই মধ্যে অঘোষিতভাবে ভাড়া বেড়েছে দুই দফা।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে প্রায় পাঁচ সহস াধিক বড় বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। সরজমিনে দেখা গেছে, দুই একটি ছাড়া এসব বাসের কোনোটিতেই ভাড়ার চার্ট নেই। তবে বাস-মিনিবাসের গায়ে পরিবহন কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধামতো ‘স্পেশাল সার্ভিস’ ‘কম স্টেপেজ’ ‘গেটলক’ ‘ননস্টপ’ ‘বিরতিহীন’ ইত্যাদি লেভেল সেঁটে গত বছর থেকে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। নগরীর সরকার নির্ধারিত রুট নং-এ/১৩২তেও (গুলিস্তান রুট) চলাচল করে লোকাল ও তথাকথিত গেটলক সার্ভিস। লোকালে আদায় করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৫ টাকা বেশি। তবে এ রুটের তথাকথিত গেটলক সার্ভিসের মিনিবাসে আদায় করা হচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ১০ টাকা হারে। খিলক্ষেত থেকে শাহবাগের ভাড়া ১৫ টাকা, আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। একইভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে যাত্রাবাড়ী রুটে। সায়েদাবাদ থেকে বাড্ডার দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। মিনিবাসে এ দূরত্বে ভাড়া আসে প্রায় ১৫ টাকা। কিন্তু তুরাগ, জেএম ভাড়া আদায় করছে ২০ টাকা। একই দূরত্বে রাইদা, ছালছাবিল ও অনাবিল বাসে আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। বাড্ডা রুটে চলাচলকারী সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিসে গুলিস্তান থেকে বাড্ডার ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৩০ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা। আবার মতিঝিল থেকে মিরপুর ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুটে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২৮ টাকা। মতিঝিল থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দূরত্ব ৮.২ কিলোমিটার। ভাড়া আসে ১৩ টাকা। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। এ রুটে চলাচলকারী বিকল্প অটো সার্ভিসের হেলপার বলেন, মতিঝিল থেকে পল্টন, শাহবাগ ও বাংলামোটর হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত যেখানেই নামেন, ভাড়া ১০ টাকা। মতিঝিল থেকে ফার্মগেটের পর মিরপুর-১২ পর্যন্ত যে কোনো স্টপেজে ভাড়া ২৫ টাকা। এটা মালিকরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সর্বনিম্ন ৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা থাকলেও ১০ টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া হয় না। একইভাবে সাইনবোর্ড থেকে গাবতলী রুটে চলাচলকারী লাব্বায়েক কোম্পানির সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। কিলোমিটার হিসেবে নয়, স্টপেজ হিসেবে ভাড়া আদায় করছেন তারা।

নগরীর সরকার নির্ধারিত রুট নং এ/২০৭-এ (আজিমপুর-আবদুল্লাহপুর) চলাচল করে লোকাল ও তথাকথিত গেটলক সার্ভিস। লোকালে আদায় করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৫ টাকা বেশি। কিন্তু তথাকথিত গেটলক সার্ভিসে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া। ফার্মগেট থেকে খিলক্ষেতের ভাড়া ৫০ টাকা। অথচ  আজিমপুর থেকে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত বাসভাড়া ৫০ টাকা। ভিআইপি অটোমোবাইলস (প্রা.লি.) এভাবেই নিজেকে অভিজাত ঘোষণা করে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে এই রুটে। এ রুটে গাড়ির সংখ্যা কম বলে নিরূপায় হয়ে মানুষ পরিবহন মালিকদের মর্জি মাফিক ভাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু ফার্মগেট থেকে খিলক্ষেত আসতে চাইলেও যাত্রীকে গুণতে হচ্ছে একইভাড়া, অর্থাৎ ৫০ টাকা। এ বিষয়ে আপত্তি করলে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সরাসরি জবাব, ‘ইচ্ছে হলে যাবেন, না হলে যাবেন না।’ আবার ওই একই মিনিবাসে একই দূরুত্বে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং থেকে আজিমপুর আসা যায় ৪০ টাকায়। আপ-ডাউনের এই বৈষম্যমূলক ভাড়াও তারা নিজেরাই নির্ধারণ করেছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে শুধু গুলিস্তান, মতিঝিল, মিরপুর, গাবতলী বা যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ রুট নয়- নগরীর প্রতিটি রুটেই বাস যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বাস মালিকরা। মালিকের হয়ে কন্ডাক্টররা যে ভাড়া হাঁকছেন, বাধ্য হয়ে যাত্রীদের সেটাই দিতে হচ্ছে।

ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে দায়িতপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) প্রতিটি রুটের দূরত্ব হিসাব করে কোন বাস কোন স্টপেজে থামবে এবং কোন দূরত্বে ভাড়া কত হবে, সেটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ২০১৫ সালে। আইনগতভাবে বাস মালিকরা ভাড়ার সেই চার্ট মানতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে কেউই মানছে না সে চার্ট। বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামকাওয়াস্তে তৎপর থাকলেও যাত্রীরা কোন সুবিধা পাচ্ছেন না।

সর্বশেষ খবর