বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পরীক্ষা শুরুর আগেই ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস!

আকতারুজ্জামান

বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস চলছেই। নানা তদারকি করেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভয়াবহ এ ব্যাধি বন্ধ করতে পারেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পর গতকাল এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৩০ মিনিট আগেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন পাওয়া গেছে। ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন প্রশ্ন ফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস  বন্ধ না হওয়ায় জাতির মেরুদণ্ড ক্রমেই    দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীরা দেশের সম্পদ নয় বরং বোঝায় পরিণত হচ্ছে। গতকাল এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। সকাল ৯টার পর থেকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এ পরীক্ষার প্রশ্ন। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটস্অ্যাপ, ভাইভারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় পরীক্ষার প্রশ্ন। ফেসবুকে ‘ফারাবি আদিফ’ নামে এক আইডি থেকে গতকাল সকাল ৯টা ২৯ মিনিটে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পোস্ট দেওয়া হয়। ৫০ নম্বরের লিখিত সৃজনশীল (লালমাই) ও ২৫ নম্বরের এমসিকিউ (চিম্বুক) পরীক্ষার প্রশ্ন আপলোড করা হয়েছে সেখানে। পরীক্ষার পর দেখা গেছে, হুবহু মিলে গেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নটি। ফলে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে ‘স্বচ্ছন্দে’ পরীক্ষা দিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। এমসিকিউর ২৫ নম্বরের অনেক পরীক্ষার্থী উত্তরও করেছেন আগে পাওয়া প্রশ্ন দেখে দেখে। পরীক্ষার আগেই ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্নের স্ক্রিনশর্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ঘেঁটে দেখা গেছে, নিলয় আহমেদ নামের আইডি থেকেও প্রশ্ন ফাঁসের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আইডিটিতে দেখা গেছে, জীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন আপলোড করে ফাঁস করা হয়েছিল পরীক্ষার প্রায় সাত ঘণ্টা আগেই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা এই প্রতিবেদককে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরীক্ষার্থী জানান, এইচএসসির বেশির ভাগ পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

 ময়মনসিংহের একটি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়া এক ছাত্র এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন তাদের কলেজের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষার আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে আসছেন। রাজধানীর একটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাসনিম তানহা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেকেই প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে জানতে পারছি। তাহলে আমরা কষ্ট করে লেখাপড়া করলাম কেন? তারা তো প্রশ্ন পেয়ে নির্ভুল উত্তর করে আসছেন। পরীক্ষার ফলাফলে তো তারা আমাদের থেকে এগিয়ে গেলেন। তাহলে মেধার মূল্যায়ন হলো কীভাবে? যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক প্রশ্ন ভাইরাল করছেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন?’ ফারাবি আদিফ আইডিতে গিয়ে দেখা গেছে ফেসবুকে তিনি নিজেকে বিজি প্রেসের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়েছেন। টাইমলাইনে দেখা গেছে, পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্র, জীববিজ্ঞান প্রথম পত্র, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র, বাংলা প্রথম পত্রসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। আর প্রতিটি প্রশ্নপত্রের জন্য পরীক্ষার্থীদের থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই ফাঁস হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমসিকিউর কিছু অংশ ফাঁস হয়েছে। সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন ফাঁস হয়নি।’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে হুবহু ফাঁস হওয়া প্রশ্নের স্ক্রিনশর্ট রয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘সাড়ে ৯টায় প্রশ্ন ফাঁস হলে তাতে কী আসে যায়? তার কিছুক্ষণ পরই তো পরীক্ষা শুরু হয়।’ পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার ওপর একের পর এক আঘাত আসছে। প্রশ্ন ফাঁস এমনই একটি আঘাত। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন না পেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের মধ্যে হতাশা নেমে আসছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এখন অভিভাবক মহল। যেভাবে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আসছে তাতে পরীক্ষাগুলোর গ্রহণযোগ্যতাই কমে যাচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমে কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে না। আসলে মূলধারার বাংলা মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। সচেতন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বাংলা মাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সরকারের দায়িত্ব শিক্ষার ওপর প্রশ্ন ফাঁসের আঘাত বন্ধ করা। কিন্তু এসব বন্ধে সরকার কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে তা দেখতে হবে। সরকারের ভূমিকা যে কার্যকর হয় না, প্রশ্ন ফাঁসই তা প্রমাণ করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর