শুক্রবার, ২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুই নেতার তীব্র কলহ জাতীয় রাজনীতিতে ছড়াচ্ছে উত্তাপ

বরিশাল আওয়ামী লীগ

রাহাত খান, বরিশাল

দুই নেতার তীব্র কলহ জাতীয় রাজনীতিতে ছড়াচ্ছে উত্তাপ

বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একক অধিপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সিদ্ধান্তই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ-পরবর্তী জমানায় হাসানাত আবদুল্লাহর কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করার দুঃসাহস কারোর নেই। কিন্তু হাসানাত আবদুল্লাহর সাজানো-গোছানো বরিশাল আওয়ামী লীগের ভিতরকার কলহ-বিবাদ দেশজুড়ে এখন আলোচনায়। সরাসরি হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে বিরোধ না হলেও তার অনুগত মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মইদুল ইসলামের সঙ্গে বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের এমপি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথের তীব্র কলহের কারণে অস্বস্তিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

দুই নেতা বার বার সংবাদ সম্মেলন করছেন আর একে অন্যের প্রতি বিষোদগার করেই চলেছেন। তাদের কথাবার্তায় জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ২৩ মে এক সংবাদ সম্মেলনে মইদুল ইসলাম অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ করেছেন এমপি পংকজ দেবনাথের বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন আছে। কিন্তু মেহেন্দীগঞ্জে আইনের শাসনের চেয়েও বড় পংকজ দেবনাথের শাসন।’

চানপুর ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বাহাউদ্দিন ঢালীর পক্ষে প্রশাসনের সহায়তায় এমপি পংকজ অনুসারীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন, কেন্দ্র দখল করেন, নৌকা মার্কার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে ভোট ডাকাতি করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহে আলম ঢালীকে পরাজিত করেন। পর্যবেক্ষকরা বলেন, মইদুল সংবাদ সম্মেলনে গুরুতর একটি অভিযোগ করে গোটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন। কারণ তিনি বলেছেন, ‘২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগে বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে চালকসহ ১১ যাত্রী পুড়িয়ে মারার ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৪ আসনের এমপি পংকজ দেবনাথ জড়িত।’ মইদুলের অভিযোগের পর কেন্দ্রীয় বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে। আর দোষ চাপিয়েছে বিএনপির ওপর। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারি দলের মদদে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। মইদুলের বক্তব্যে তা-ই প্রমাণ করে। মইদুল বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে এবং মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পংকজের নির্দেশে তার মালিকানাধীন বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এমপি নির্বাচিত হন। নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হলেও এখন নৌকা দেখলেই পংকজ দেবনাথের মাথা খারাপ হয়ে যায়। মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধাচরণ করে দুটি ইউনিয়নেই পংকজ বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। এর আগে তিনি উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। ২৫ মে এমপি পংকজ দেবনাথ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে মইদুল ইসলাম কার স্বার্থ রক্ষা করছেন? তিনি মইদুলের বক্তব্যকে অসত্য ও ভ্রান্ত অভিহিত করে বলেন, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে বহুকষ্টে অর্জিত তার রাজনৈতিক ভাবচ্ছবি বিনষ্টের অপচেষ্টা করা হচ্ছে। পংকজ বলেন, ‘মইদুল ইসলাম সিনিয়র রাজনীতিক। তিনি এটি বুঝে বলেছেন নাকি না বুঝে বলেছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে এটা ঠিক, বিহঙ্গ পরিবহনের মালিকদের মধ্যে আমি একজন। বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় এমন দিন ছিল না যে, আমাদের গাড়ি পোড়ানো হয়নি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।’ এদিকে পংকজের অনুসারীরা বলছেন, জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন মইদুল। তাকে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি করা হয়েছে। এটা সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি তারা। এর ওপর বিভিন্ন ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে মইদুল-পংকজ বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, ‘জাতীয় পার্টির সময় মেহেন্দীগঞ্জের জাঙ্গালিয়ায় ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান, বিএনপির সময় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান হওয়া আবুল হোসেন হাওলাদারকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছেন মইদুল ইসলাম। এতে ক্ষুব্ধ ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।’ সব শেষ চানপুর ইউনিয়নে তৃণমূলের মতামত না নিয়ে যাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেই মাহে আলম ঢালী ২০০১ সালের পয়লা অক্টোবরের নির্বাচনের পর ছাত্রলীগ নেতা মন্টুর হাত কেটেছেন এবং যুবলীগ নেতা সেলিমকে মারধর করেছেন। তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। দলে অনুপ্রবেশকারীদের প্রাধান্য দেওয়ায় মেহেন্দীগঞ্জের তৃণমূল আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বলে জানান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ভুলু। পংকজ নাথ এমপি বলেন, ‘মইদুলকে দলে যোগদান করানোয় তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ।

 বিশেষ করে মইদুল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর পুরনো ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারী নিজস্ব লোকজনের হাতে সব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি (মইদুল) উপজেলা নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীর কাছ থেকে ৩০ লাখ এবং পৌর নির্বাচনে দলের প্রার্থীর কাছ থেকে ২৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। তৃণমূলের মতামত না নিয়ে সব ইউনিয়নে লাখ লাখ টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন। এমনকি নির্বাচনী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সভা করেননি, মনোনয়ন দেওয়ার পরও কোনো সমন্বয় সভা করেননি, গঠন করেননি কোনো নির্বাচন পরিচালনা কমিটি।’

তিনি আরও বলেন, ‘চানপুর ইউনিয়নে জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় এবারের সংকটের সৃষ্টি। দুর্বল প্রার্থী দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে স্থানীয় এমপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন তারা।’ এসব বিষয়ও কেন্দ্রে জানানো হয়েছে বলে জানান পংকজ নাথ।

দুই নেতার কাদা ছোড়াছুড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুছ এমপি।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে আওয়ামী লীগের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপির মুঠোফোনে একাধিকবার রিং দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ খবর