বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

কুয়াকাটা সৈকতের উন্নয়ন শুধু পরিকল্পনাতেই

রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার দাবি

রাহাত খান, কুয়াকাটা থেকে ফিরে

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের এই সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় উপভোগ করা যায় বলে পর্যটকদের কাছে কুয়াকাটা আদর্শ স্থান। কুয়াকাটা ছাড়া পৃথিবীতে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায় জাপানে। এবারের ঈদে এ সমুদ্রসৈকতে ছিল পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়। এখানকার উন্নয়ন শুধু মহাপরিকল্পনা ও ফাইলের মধ্যে বন্দী থাকলেও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে মানুষ ছুটে গেছে সমুদ্রের পাড়ে। ১৯৯৬ সালে কুয়াকাটাকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার পর রাস্তাঘাটের দৃশ্যমান কিছু উন্নতি হলেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়ায় তেমন বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে পারছে না ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকত। কুয়াকাটা ঘিরে সরকারের মহাপরিকল্পনা যেন শুধুই কাগজে-কলমে আবদ্ধ। তবু কুয়াকাটা ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন এখানকার মানুষ। তবে এ ধরনের একটি জায়গার যথাযথ উন্নয়ন না হওয়ায় অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেন। রাজনৈতিক বিতর্কে না গিয়ে কুয়াকাটা পর্যটনের উন্নয়নে দ্রুত মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন স্থানীয় হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির নেতারা।

১৯৮২ সালে পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা আসতে তিন দিন লাগত ব্যবসায়ী আবুল বাশার রিপনের। এখন লাগছে মাত্র সোয়া ঘণ্টা। এর পরও কুয়াকাটার প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি বলে মনে করেন তিনি। তার মতো অন্য পর্যটকরাও মনে করেন, পরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে না কুয়াকাটা পর্যটনের। এখনো কর্দমাক্ত মাটির রাস্তা মাড়াতে হয় পর্যটকদের। হোটেল-মোটেল-রেস্টুরেন্টে থাকা-খাওয়ায় অত্যধিক খরচের অভিযোগ পর্যটকদের। নোংরা সৈকত। সাইট ট্যুরের ব্যবস্থা নেই আগন্তুকদের জন্য। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল কিংবা ছবি তোলায়ও অতিরিক্ত খরচ হয়। এ ছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় বখাটে-মস্তানদের হাতে পর্যটক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। পর্যটকরা সৈকতের যে স্থানে নেমে হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ করেন, সেখানে সাগরগর্ভে বিলীন হওয়া একটি সরকারি দফতরের অবকাঠামোর অবশিষ্টাংশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হচ্ছেন অনেকে। এসব দিকে কারও বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই অভিযোগ পর্যটক বিশ্বাস মহসিন ও মো. মিন্টুর। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত সমুদ্রগর্ভে বিলীন হচ্ছে সৈকত। ভাঙনের কারণে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে মনে করেন কেউ কেউ।

পটুয়াখালীর সিনিয়র সাংবাদিক কাজল বরণ দাস বলেন, বরিশাল থেকে কলাপাড়া পর্যন্ত সড়কটি মোটামুটি ভালো হলেও কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত শেষ ১৮ কিলোমিটার সড়ক যানবাহন চলাচলের অনেকটা অনুপযোগী। ভাঙাচোরা এই সড়কে একবার যাতায়াত করলে দ্বিতীয়বার আর আসতে চান না পর্যটকরা।

কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছে বলে অভিযোগ তার। সর্বোপরি পর্যটকদের জন্য নিশ্চিন্ত বিনোদনের একটি পার্ক দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, কুয়াকাটা ঘিরে অনেক উন্নয়ন হওয়ার কথা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

কুয়াকাটার কর্দমাক্ত রাস্তায় পর্যটকদের অনীহায় নিজের অসন্তোষের কথা জানিয়ে কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল বারেক মোল্লা বলেন, ‘সরকারের মহাপরিকল্পনায় বিচ প্রটেকশন, বেড়িবাঁধের উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট, ড্রেন-কালভার্টসহ বহু উন্নয়ন হবে। তবে পদ্ধতিগত কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগছে।’ পটুয়াখালী, কলাপাড়া, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটা ঘিরে সরকারের বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে বলে দাবি বারেক মোল্লার।

বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কে তিনটি সেতু নির্মাণ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার কোনো উন্নয়ন করেনি বলে দাবি করেছেন কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিন মুসল্লি। কুয়াকাটা ঘিরে সরকারের মহাপরিকল্পনাকে স্রেফ ধোঁকা বলে অভিহিত করেছেন স্থানীয় এই বিএনপি নেতা।

রাজনৈতিক বিতর্কে না গিয়ে কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন পাওয়া মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটায় পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে। তিনি বলেন, পর্যটনের উন্নয়নে কুয়াকাটায় জরুরি দরকার বিচ প্রটেকশন, মেরিন ড্রাইভ, পর্যটকদের উপভোগের জন্য অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল এবং একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটা আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে মনে করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালে সরকার স্থানীয়দের মতামতের ভিত্তিতে কুয়াকাটা মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ওই প্ল্যান সরকারপ্রধানের অনুমোদন পেলেও আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের দুই প্রান্তে সাড়ে ৪ কিলোমিটার বিচ প্রটেকশন, মেরিন ড্রাইভ, ৫ ফুট উঁচু ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধসহ চার লেনবিশিষ্ট রাস্তা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিভিন্ন সরকারি দফতর, রিং রোড ও অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট, ড্রেন-কালভার্ট নির্মাণসহ বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে কুয়াকাটা মাস্টারপ্ল্যানে। পর্যটনের বিকাশে দ্রুত এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন এখন এ অঞ্চলের মানুষের সময়ের দাবি।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, কুয়াকাটা মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন হয়ে গেছে। এখন সেই মাস্টারপ্ল্যানের রিভিউ চলছে। এরপর কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করে অচিরেই কুয়াকাটা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে কুয়াকাটাকে বিশ্বসেরা পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

সর্বশেষ খবর