সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

পুঁজি সংকটে চামড়া ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহীর প্রায় দেড়শ চামড়া ব্যবসায়ীর টাকা কয়েক বছর ধরেই আটক রয়েছে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। ফলে পুঁজি সংকটে পড়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। তাই এবার কোরবানি ঈদে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা চামড়া কিনতে পারবেন কিনা তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন। স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা পুঁজি সংকটে থাকলেও হুন্ডির মাধ্যমে ভারত থেকে টাকা আসছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে তাদের এবার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনতে হবে। আর অতিরিক্ত দামে কেনা এসব চামড়া সীমান্তপথে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আগাম টাকা এনেছেন বলে তারা    জানতে পেরেছেন। রাজশাহী জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ জানান, তাদের সংগঠনে ১৩৫ জন সদস্য আছেন। ঢাকায় এসব ব্যবসায়ীর কারও কারও ৮ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাকি পড়ে আছে। বার বার তাগিদ দিয়েও তারা টাকা আদায় করতে পারছেন না। ফলে এবার ঈদে চামড়া কিনতে পুঁজি সংকটই প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। ব্যবসায়ীরা জানান, রাজশাহীতে প্রতি কোরবানি ঈদে প্রায় ৮০ হাজার গরু-মহিষ ও প্রায় দেড় লাখ ছাগল-ভেড়া কোরবানি হয়ে থাকে। এই বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবসায়ীরা কিনে কয়েকদিন সংরক্ষণের পর নাটোরের আড়তগুলোতে নিয়ে যান। সেখান থেকে ঢাকার ট্যানারি মালিকরা তা কিনে নেন। এসব চামড়ার প্রায় পুরোটিই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিক্রি করতে হয় বাকিতে। তবে আগে বিক্রির ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যে ট্যানারি মালিকরা টাকা পরিশোধ করে দিতেন। কিন্তু গত তিন বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা কোরবানি ঈদের চামড়ার প্রায় ৮০ ভাগ টাকা এখনো পরিশোধ করেননি। তারা তাদের ট্যানারি স্থানান্তরের অজুহাতে রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রাখছেন। এতে পথে বসতে শুরু করেছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। তিন বছর আগেও মোশাররফ হোসেন ছিলেন একজন চামড়া ব্যবসায়ী। কিন্তু এখন তিনি চামড়াশিল্পের শ্রমিক। কাজ করেন রাজশাহী মহানগরীর রেলগেট এলাকার একটি চামড়ার আড়তে। মোশাররফ বলেন, ‘পুঁজি যা ছিল, সব শেষ। এখন চামড়া আড়তে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি।’ তিন বছর আগে মোশাররফ হোসেনেরই একটি চামড়ার আড়ত ছিল। সেখানে কাজ করতেন শ্রমিক। এখন মোশাররফ নিজেই শ্রমিকের কাজ করেন আরেকজনের আড়তে। মোশাররফ হোসেন জানান, ৪০ বছরের জীবনে তিনি ২০ বছর ধরেই চামড়ার সঙ্গে আছেন। প্রথম ১০ বছর শ্রমিকের কাজ করতেন। পরের ৭ বছর তিনি ব্যবসা করেছেন। তার পুঁজি হয়েছিল প্রায় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু গত তিন বছর আগে ঢাকায় ট্যানারি মালিকদের কাছে তার ৮ লাখ টাকা বাকি পড়ে যায়। তারপর বহু চেষ্টা করেও সে টাকা আদায় করতে পারেননি। শেষে গুটিয়ে ফেলতে হয় ব্যবসা। এখন তিনি ব্যবসা ছেড়ে কাজ করেন অন্যের আড়তে। জুলফিকার আলী নামে একজন চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, কোরবানি ঈদে চামড়া কিনতে তাদের মৌসুুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও প্রায় সময়ই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারণে চামড়া কিনতে হয় বেশি দামে। এখন আবার প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা কম। ফলে এবার ঈদে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অনেক চামড়া কিনে ফেলবে। আর সেসব চামড়া ট্যানারিতে না গিয়ে সীমান্তপথে ভারতে পাচার হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, কোরবানির চামড়ার পাচার ঠেকাতে প্রশাসন তৎপর থাকবে। বিষয়টি নিয়ে জেলার মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে।

 সেখানে তিনি এ বিষয়ে সজাগ থাকতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। সীমান্তে কড়া নজরদারি করার জন্য বিজিবি কর্মকর্তাদেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, এখানকার ব্যবসায়ীদের এবার পুঁজি সংকট প্রকট থাকায় এরই মধ্যে ভারত থেকে হুন্ডির মাধ্যমে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা আসছে। তাই যে কোনোভাবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভারতে চামড়া পাঠানোর চেষ্টা করবে। এ বছর অল্প পুঁজি নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চামড়া কেনা তাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

এবার কোরবানির চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের ১৮৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রূপালী ব্যাংক। পাশাপাশি জনতা ব্যাংক ৩০০ কোটি, সোনালী ব্যাংক ১৫০ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া সরকারি খাতের কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক এ খাতে কিছু ঋণ দেবে। এর বাইরে বেসরকারি খাতে ন্যাশন্যাল ব্যাংক, সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এই খাতে সীমিত আকারে অর্থায়ন করবে। তবে এই ব্যাংকগুলোর ঋণ শুধু ট্যানারি মালিকদের জন্য।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, ট্যানারি মালিকরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রেখেছেন। তাই ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া দরকার। তা না হলে চামড়া কেনা কঠিন। তাছাড়া লবণের দামও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছে পরিবহন খরচ এবং শ্রমিকের মজুরিও। এসব কারণ ছাড়াও পুঁজির অভাবে এবার ঈদকেন্দ্রিক চামড়া ব্যবসার কি হয় তা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় আছেন।

আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, গত বছর এক বস্তা লবণের দাম ছিল এক হাজার টাকা। এ বছর কোরবানির ঈদের আগেই সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন এক বস্তা লবণের দাম এক হাজার ৪০০ টাকা। গত বছর একটি গরুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতেই তাদের ৪৫০ টাকা খরচ হয়েছে।

মাসুদ মনে করেন, এ বছর খরচ আরও বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা কম। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা একেবারে সংকটের মধ্যে পড়েছেন। কোরবানির পশুর চামড়া কেনা নিয়ে গত ২০ বছরেও ব্যবসায়ীদের এমন ‘বিপদের’ মুখে পড়তে হয়নি বলে দাবি তার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর