মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রশাসনের সংস্কৃতিজন আবদুল মান্নানের কথা

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

প্রশাসনের সংস্কৃতিজন আবদুল মান্নানের কথা

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান প্রশাসনের ‘সংস্কৃতিজন কর্মকর্তা’। প্রগতির যাত্রা পথে সাহসী ও সংবেদনশীল চরিত্র। মৌলবাদী খড়গের বিপরীতে জীবনঝুঁকি নিয়ে সাহসী অবস্থানের কারণে জুটেছে তাঁর ‘রক্ত চক্ষু শাসানি’ও। তবুও নিঃশঙ্ক চিত্তে তাঁর পথ চলা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক, মা মাটিই যেন তাঁর ভাবনার জগৎ। স্পষ্টই বলেন, শিল্প ও সাহিত্য নিয়েই আমার জীবন। সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে যে কোনো বাধার বিপক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ডিসি হিলের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে বাধা প্রদানের অভিযোগে অনেকটা উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। বিস্মিত হন। তিনি বলেন, আমি কবিতা ভালোবাসি। সংগীতের অনুরক্ত। নিজে মঞ্চে উঠে আবৃত্তি করি। চট্টগ্রামের এমন কোনো প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন নেই যাদের অনুষ্ঠানে আমি যাইনি। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসন ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সংকোচন আরোপ করে বছরে মাত্র তিনটি অনুষ্ঠান করার জন্য নিয়ম বেঁধে দিলেও বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে আবদুল মান্নান যোগদান করার পর থেকে তাঁর ইচ্ছেয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে প্রসারতা ঘটে।

তিনি জানান, চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ‘বোধন’-কে বসন্ত উৎসব করার জন্য অনুমতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি নিজেই। একুশে বইমেলা ও মে দিবস উপলক্ষে একই ভাবে অনুমতির ব্যবস্থা করেন সংস্কৃতিজন বিভাগীয় এই প্রধান কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মকালেও রাখেন ব্যাপক সফলতার সাক্ষর। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রণোদনা দেওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণ ও সংস্কৃতি কর্মীদের দ্বারা ‘সংস্কৃতিকজন জেলা প্রশাসক’ হিসেবে অভিহিত হন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নামে মিউজিয়াম, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে ‘ভাষা মঞ্চ’ ও ‘ভাষা চত্বর’ তৈরি করেন এই সরকারি কর্মকর্তা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অদ্বৈত মল্ল বর্মণের পৈতৃক ভিটেয় ‘অদ্বৈতমেলা’ আয়োজন করেও ব্যাপক প্রশংসিত হন। হিন্দুদের পুরনো মঠ-মন্দির সংস্কার করেন। মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মাণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌলবাদীদের ঠেকিয়ে আইয়ুব বাচ্চুসহ বিশিষ্ট জনদের দিয়ে অনুষ্ঠান করার মধ্য দিয়েও ব্যাপক সাহসিকতার পরিচয় দেন আবদুল মান্নান। চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিপুল খাস জজি ভূমি দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনেন তিনি। আশুগঞ্জে চাটাল কর্মী নারী শ্রমিকদের শিশু সন্তানদের জন্য অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত টানা সংগ্রামের সুদৃশ্য দেয়াল ভাস্কর্য তৈরি করেও প্রশংসা পান তিনি।

২৮ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি শুরু তাঁর। ছিলেন ইউএনও থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরেই। সচিবালয়ে ১২ বছর চাকরি করেন। ৭-৮টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরির অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও। পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিলেন। এডিসি হিসেবে চাঁদপুরে, ডিসি হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। রাজউকের পরিচালক ছিলেন। পূর্বতন চাকরির সূত্রেই শুধু নয়, বহু আগে থেকেই তিনি চট্টগ্রামকে জানেন গভীরভাবে। চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক থাকাবস্থায় আবদুল মান্নান চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, মুসলিম হল ব্যাপক সংস্কার করেন। সবকটি মঞ্চে ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রণোদনা দেন। মুক্তিযোদ্ধা ও দুস্থ শিল্পীদের সহায়তা করেন। স্বনামধন্য জাতীয় শিল্পীদের এনে চট্টগ্রামে পরিবেশনাও করান তিনি। লেখালেখিতেও ব্যাপকভাবে নিমগ্ন বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান। আগামী প্রকাশনী, পাঠক সমাবেশ ও পালক থেকে বই প্রকাশিত হয় তাঁর। আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকায় লিখেন নিয়মিত। শিল্পী আবদুল জব্বারকে নিয়েও লেখালেখি করেছেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ‘সরোজ’ ও চট্টগ্রাম থেকে ‘সাম্পান’ নামে দুটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর লেখা গল্প ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’-এর ওপর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। বিটিভি’-তে প্রচার হওয়া এ নাটক দর্শক নন্দিত হয়েছে। সন্ত্রাস ও মৌলবাদী ত্রাসের বিরুদ্ধে মাঠে ছিলেন অসীম সাহসিকতায়। বিগত জাতীয় নির্বাচন (২০১৪)-এর পূর্বে সড়কে গাছ কেটে ত্রাস সৃষ্টির প্রতিবাদে জননিরাপত্তার স্বার্থে জীবনঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামায় সে সময় ব্যাপক আলোচনায় আসা এই সরকারি কর্মকর্তার প্রগতির পক্ষেই অবস্থান। তিনি মনে করেন, সংস্কৃতি চর্চাই মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। যার অন্তরে শুদ্ধ সংস্কৃতির প্রবাহ আছে তিনি সুনাগরিক। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সুনাগরিকের দ্বারাই সম্ভব। কাজে জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থেই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন একাধিক গ্রন্থ প্রণেতা এই শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর