শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্নীতির প্রতিবেদন বদলে দিয়ে উল্টো পদোন্নতির সুপারিশ!

আরএমপির দুই কর্মকর্তার যত অপকর্ম

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) ঠিকাদারি, বদলি বাণিজ্য সব ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। থানার ওসিরা গিয়েও ধরনা দিতেন এ দুজনের কাছেই। এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন রাজশাহী নগর পুলিশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিব ও প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুস। তাদের দুর্নীতি নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন হয়। সেই প্রতিবেদনও বদলে দেন তারা। ফিরতি প্রতিবেদনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে তা সদর দফতরে জমা দিয়ে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার পাচ্ছেন না লতিব। অবশেষে বিজ্ঞপ্তি না ছাপিয়ে আড়াই কোটি টাকার কাজের দরপত্র পছন্দের ঠিকাদারকে দেওয়ায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিবের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে তদন্ত। আর পুলিশ কমিশনারের স্বাক্ষর জাল করে পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন দেওয়ায় প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুসকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত। নগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান জানান, কোনো দুর্নীতিবাজের ঠাঁই হবে না। প্রাথমিকভাবে আবদুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আবদুল লতিবের বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগ সম্পর্কে আরএমপির প্রশাসনিক অফিসার আবদুল লতিব, প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুস ও হিসাবরক্ষক জুলমাত হাবিবের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। নগর পুলিশ সূত্র জানায়, একটি দরপত্রে অনিয়মের ব্যাপারে সম্প্রতি প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুসের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে তদন্ত শুরু হয়। এ নিয়ে গত এপ্রিলে পুলিশ কমিশনার তাকে শোকজ করেন। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগের তদন্তও করেন। তদন্ত শেষে আরএমপি কমিশনার অভিযুক্ত প্রধান সহকারীকে দিয়েই পুলিশ সদর দফতরে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রতিবেদনের চিঠির খাম হাতে পেয়ে আবদুল কুদ্দুস তা খুলে দেখেন। এ সময় নিজের অপকর্মের নানা ফিরিস্তি লিপিবদ্ধ দেখে তিনি ওই প্রতিবেদন বদলে দেন। আরএমপি কমিশনারের স্বাক্ষর জাল করে তিনি নিজের মতো করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। এতে তিনি নিজেকে নির্দোষসহ পদোন্নতিরও সুপারিশ করেন। এরপর তিনি সেটি পুলিশ সদর দফতরে জমা দেন।

তবে প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দফতরেরই সন্দেহজনক মনে হয়। তাই সেটি আবার আরএমপিতে ফেরত পাঠায়। এর পরই আবদুল কুদ্দুসের জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। তার পরও বিষয়টি তদন্তে আরএমপি কমিশনার অতিরিক্ত কমিশনার শিরিন আক্তারকে দায়িত্ব দেন। এরপর গত বৃহস্পতিবার তিনি প্রতিবেদন জমা দিলে ওইদিনই আবদুল কুদ্দুসকে সাময়িক বরখাস্ত করেন কমিশনার মাহবুবর রহমান।

এদিকে নকল পত্রিকা ছাপিয়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিবের বিরুদ্ধে। নজিরবিহীন এ জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয়েছে তোলপাড়। পুলিশ সদর দফতর ও রাজশাহী মহানগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

সূত্র জানায়, তদন্তে প্রাথমিকভাবে এ জালিয়াতির জন্য আরএমপির বহুল আলোচিত প্রশাসনিক অফিসার আবদুল লতিব, প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুস ও আরএমপির হিসাবরক্ষক জুলমাত হাবিবকে দায়ী করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আরএমপিতে ওই সময়ে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। তবে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে আপাতত আরএমপির কমিশনার এ তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আরএমপিতে আগেও ওষুধ কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছিল। দীর্ঘদিন একটি চক্র মুন্না নামের ঠিকাদারের সহযোগিতায় এ ধরনের দুর্নীতি করছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (সদর দফতর) ও আরএমপির মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম জানান, পুলিশ সদর দফতর থেকে এসব জালিয়াতির ঘটনা ও অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। এর আগে একই বিষয়ে তদন্ত করছিল সিকিউরিটি সেল বা পুলিশের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড-২ বিভাগ। তদন্তের প্রাথমিক ফল ও প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরএমপির কমিশনার অধীনস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রধান সহকারী ও হিসাবরক্ষককে কৈফিয়ত তলব করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর পুলিশের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের যন্ত্রপাতি ও অফিস সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ছাপা বিজ্ঞপ্তিসংবলিত একটি জাতীয় দৈনিকের কপি আরএমপির টেন্ডার ফাইলে দেখানো হয়েছে। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটির নম্বর-১/(২০১৬-২০১৭)। কিন্তু সারা দেশে প্রকাশিত ও প্রচারিত ওই দৈনিকটির একাধিক সংস্করণের কোনো কপিতেই আরএমপির এ বিজ্ঞপ্তিটি নেই। আসলে আরএমপির টেন্ডার জালিয়াতির জন্য অভিযুক্তরাই মুন্না নামের একজন ঠিকাদারের যোগসাজশে ওই জাতীয় পত্রিকাটির নকল কপি ছাপিয়েছেন, যা শুধু টেন্ডার ফাইলে ব্যবহার করা হয়েছে। এ টেন্ডারে ৮৬ লাখ টাকার মাল সরবরাহ করার কথা

একইভাবে আরও দুটি টেন্ডার জালিয়াতির জন্য আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তার ফাইলে একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকের ছাপা নকল কপি পাওয়া গেছে; যাতে তাদের সরবরাহ ও জিনিসপত্র কেনাকাটার দুটি পৃথক টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপা রয়েছে। এসব বিজ্ঞপ্তির সূত্রেই ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজশাহী মহানগর পুলিশ তাদের বার্ষিক কেনাকাটার কাজ সম্পন্ন করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই অর্থবছরের জন্য পুলিশের মনিহারিসামগ্রী সরবরাহের অন্য বিজ্ঞপ্তিটি ছাপা একটি ইংরেজি দৈনিকের কপি শুধু আরএমপির টেন্ডার ফাইলে দেখানো হয়েছে। পত্রিকাটি ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বলে দেখা গেছে। ওই পত্রিকারও ওইদিন বাজারে বিক্রীত বা ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত কোনো কপিতে এ বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়নি। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন, এ রকম কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাপার কোনো চিঠিও তারা আরএমপি থেকে পাননি। ফলে তারা ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেননি। এজন্য কোনো বিলও দাখিল করেননি। এটি ৪৬ লাখ টাকার টেন্ডার।

একইভাবে পুলিশের ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালামাল সরবরাহ, মোটরযান যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও মেরামত, ফোর্সের পোশাক সেলাই এবং এসআই ও তার নিম্নপদস্থ সদস্যদের রিবন সরবরাহের তৃতীয় দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি ছাপা আরেকটি জাতীয় দৈনিকের কপি আরএমপির টেন্ডার ফাইলে দেখানো হয়েছে। এটি ২০১৬ সালের ৪ মের কপি। পত্রিকারও ওইদিন বাজারে বিক্রীত বা ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত কোনো কপিতে এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। এটি ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার টেন্ডার। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন, এ রকম কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাপার কোনো অর্ডার কপি আরএমপি থেকে তারা পাননি এবং বিলও দাখিল করেননি।

তবে দুটি পত্রিকার কর্তৃপক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাকে নিশ্চিত করেছেন যে, আরএমপির এসব বিজ্ঞপ্তি বা বিজ্ঞাপনের জন্য কোনো বিল তারা দাখিল করেননি। তবে অন্যান্য বিজ্ঞাপনের বিলের সঙ্গে আরএমপির হিসাব বিভাগ থেকে একই চেকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়েছে, যা এ বিলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিবের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন টেন্ডার জালিয়াতি ও কারসাজি করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান উত্তরপাড়ায় লতিবের একটি ছয় তলা বাড়ি রয়েছে। অন্যদিকে এ বছর জানুয়ারিতে লতিব ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় একজন ডাক্তারের কাছ থেকে।

সর্বশেষ খবর