সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভালো নেই রংপুরের ভাষাসৈনিকরা

খোঁজ রাখেন না কেউ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। ভাষাসংগ্রামে পিছিয়ে ছিল না রংপুর। ১৯৪৮ থেকে ’৫২ পর্যন্ত রংপুরের ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলনে রংপুরের যেসব ভাষাসৈনিক সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ৪-৫ জন আজও বেঁচে আছেন। রংপুরের প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল, শাহ তবিবর রহমান প্রধান, আশরাফ হোসেন বড়দা এবং মীর আনিসুল হক পেয়ারা তাদের মধ্যে অন্যতম। রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন মোহাম্মদ আফজাল। বয়সে ছোট হলেও প্রতিটি মিটিং-মিছিলে তার ছিল উচ্চকণ্ঠ। পরবর্তীকালে তিনি ছিলেন পৌর চেয়ারম্যান, গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টাম লীর সভাপতি।

সংগ্রামী, নির্লোভ ও রাজনীতির কারণে সংসারি হননি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় কারাবাস করেছেন। তিনি এখন নিজ বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙে পড়েছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। চোখেও কম দেখেন। কখনো কখনো কানে ভালো শুনতেও পান না। নগরীর মুন্সিপাড়ায় তার বাড়িতে কথা হয় মোহাম্মদ আফজালের সঙ্গে। বাড়ির একটি অংশ ছাত্রদের মেস ভাড়া দিয়েছেন।

 স্ত্রী-সন্তান না থাকায় দু-একজন নিকটাত্মীয় আর ভাড়াটিয়া ছাত্রই তার দেখাশোনা করেন। ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেন। রংপুরের মানুষের কাছে যিনি পরিচিত ‘বড়দা’ নামে। তার জীবনে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি প্রবন্ধ পড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ হন তিনি। প্রগতিশীল শিক্ষক স্যার সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছে পেয়েছিলেন প্রাণের ভাষা বাংলার জন্য অনুপ্রেরণা। আশরাফ হোসেন জানান, ১৯৫২ সালে তিনি লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তখন থেকে লালমনিরহাটের আবুল হোসেন, শামছুল হক, আনিছুল হক, ষষ্ঠী সরকার, নাসির উদ্দিন, নাসিম আহমেদ, টুক চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে মিছিলে শরিক হতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের খবর শুনে রংপুরের রাজপথে নামেন। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। আন্দোলনের কারণে ১৯৫৪ সালে আত্মগোপনে চলে যান আশরাফ হোসেন। ১৯৫৫ সাল থেকে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে তিনি বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়েছেন। কখনো লাঠিতে, নয়তো অন্যের হাত ধরে চলাফেরা করেন। কমেছে স্মৃতিশক্তিও। তবে ৬৭ বছর আগের ভাষাসংগ্রামের দিনগুলোর স্মৃতি স্মরণ করতে ভুল হয় না তার। শাহ্ তবিবর রহমান প্রধান। রংপুর মহানগরীর গুপ্তপাড়ার নিউক্রস রোডে তার বাসা। সেখানেই অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনিও বয়সের ভাড়ে ভারাক্রান্ত। ছাত্রাবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার নেতৃত্বে রংপুর জিলা স্কুল থেকে মিছিল বের হতো। ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রংপুরের বদরগঞ্জে এক বিশাল জনসভা হয়। তিনি ওই জনসভায় বক্তৃতা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তবিবর রহমান জিলা স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়লেও ভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। ভাষাসংগ্রামে যুক্ত হওয়ার কারণে একসময় তাকে কারমাইকেল কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করেন ছাত্ররা। তখন থেকেই রংপুরে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন মীর আনিসুল হক পেয়ারা। বর্তমানে তার বয়স ৮৩। চার বছর আগে জীবন সঙ্গিনী নুরজাহানের মৃত্যু হয়েছে। এরপর থেকে তিনি একা হয়ে পড়েছেন। চার মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে তার। আনিসুল হক পেয়ারা গত ছয় মাস ধরে চলাফেরা করতে পারছেন না। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার পর থেকে বিছানাকে সঙ্গী করে নিয়েছেন তিনি। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা আর দুর্ঘটনার ব্যথা তাড়া করছে তাকে। বাসা থেকে তেমন একটা বের হতে পারেন না। প্রাচীনতম এ জেলায় ভাষা আন্দোলনে নাম জানা, অজানা অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন- লে. কর্নেল জাহিদুল হক চৌধুরী, শামসুল হুদা (আবু), অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম, সিদ্দিক হোসেন, ডা. রোকেয়া আলমগীর রুবি, কমরেড বিনয় সেন, মজিবর রহমান মতি মিয়া, ডা. শোভান খান, ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার), মকবুল হোসেন, কানু ঘোষ, আফান উল্লাহ, মোসলেম আলী খান, ইব্রাহিম খান সুরুজ, ডা. কবির খান বখতিয়ারি, অ্যাডভোকেট গাজী রহমান, কামরান শাহ আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক রেজা শাহ তৌফিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, তোজাম্মেল আলী, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, শাহ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আফজাল, আশরাফ হোসেন বড়দা, শাহ্ তবিবর রহমান প্রধান, মীর আনিসুল হক পেয়ারা, তনসিম উদ্দিন আহমেদ মনু ও পানার উদ্দিনসহ আরও অনেকেই। তবে তাদের কেউই এখন ভালো নেই।

সর্বশেষ খবর