সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর যখন দাঁতের চিকিৎসা

ছড়াচ্ছে প্রাণঘাতী রোগ

শামীম আহমেদ

ভয়ঙ্কর যখন দাঁতের চিকিৎসা

নিয়ম-নীতির বালাই নেই স্পর্শকাতর দাঁতের চিকিৎসায়। এইডস, হেপাটাইটিসের মতো প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকলেও নেওয়া হচ্ছে না প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। জীবাণুমুক্ত না করে একই সরঞ্জাম দিয়ে চিকিৎসা চলছে অসংখ্য রোগীর। অনেক হাসপাতাল-চেম্বারে জীবাণুমুক্ত করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। যাদের আছে তারাও ঝামেলা এড়াতে বা খরচ কমাতে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে রোগীর অজান্তেই তার শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাণঘাতী নানা সংক্রামক রোগ। দিনের পর দিন সবার চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাই নেই।

জানা গেছে, সাধারণত অটোক্লেভ মেশিন বা সাইডেক্স জাতীয় রাসায়নিক দিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করা হয়। তবে রাজধানীর বিভিন্ন ডেন্টাল কলেজ ও ডেন্টাল চেম্বার সরেজমিন ঘুরে তেমন কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। কোথাও লোক দেখানো অটোক্লেভ মেশিন থাকলেও তা নষ্ট অথবা ব্যবহার করা হচ্ছে না। চিকিৎসা সরঞ্জাম ট্যাপের পানি বা সর্বোচ্চ স্যাভলন মেশানো পানিতে ধুয়ে অন্য রোগীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। রোগী সেজে রাজধানীর মিরপুর, বাড্ডা ও রামপুরার বিভিন্ন ডেন্টাল চেম্বার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা ডেন্টাল কলেজের আশপাশেই গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত ডেন্টাল চেম্বার। অনেকগুলোয় ডাক্তারের সাইনবোর্ড থাকলেও বসেন না কোনো বিডিএস ডাক্তার। ডেন্টাল কলেজের টেকনিশিয়ানরাই সেখানে চিকিৎসা করেন। অভিযানের খবর পেলে ফোন করে ডাক্তার ডেকে আনা হয়। অধিকাংশ চেম্বারে সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক চেম্বারের মালিক বা চিকিৎসক পদধারী ব্যক্তি অটোক্লেভ মেশিনের নামও জানেন না। রোগী সন্তুষ্ট করতে কয়েকটি ক্লিনিকে রাখা হয়েছে বৈদ্যুতিক হিটার। সচেতন রোগী দেখলে তার সামনে খোলা স্টিলের পাত্রে গরম পানি দিয়ে সরঞ্জাম পরিষ্কার করা হয়। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সৈয়দ আহসান তৌহিদ বলেন, স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে বা সাধারণ পাত্রে কয়েক মিনিট ফুটালে সব জীবাণু ধ্বংস হয় না। চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত না করে সার্জারি করলে রক্তবাহিত যে কোনো রোগ ছড়াতে পারে। অনিরাপদ দাঁতের চিকিৎসা থেকে এইচআইভি (এইডস), হেপাটাইটিস বি বা সি-এর মতো প্রাণঘাতী রোগও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সাধারণত রাসায়নিক দিয়ে বা অটোক্লেভ মেশিনে ১২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ ও ১৫ পিএসআই চাপে ১৫-৩০ মিনিট (যন্ত্রাংশের পরিমাণের ভিত্তিতে) বা ১৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে ৩-১০ মিনিট রেখে সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় এক কোটি মানুষ আক্রান্ত। ফোরাম ফর দি স্টাডি অব দি লিভারের তথ্যানুযায়ীÑ বাংলাদেশে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে বছরে ২২ হাজার ৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এদিকে সংক্রামক রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ায় গত বছরের নভেম্বরে জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করে সরকার। তাতে বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা ঘটাতে সহায়তা করেন বা সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি গোপন করেন, তাহলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। আইনে এইচআইভি (এইডস), ভাইরাল হেপাটাইটিস, ইবোলা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়াসিস, টাইফয়েডসহ ২৩টি সংক্রামক রোগের নাম উল্লেখ করা হয়। অথচ তদারকির অভাবে ডেন্টাল হাসপাতাল ও চেম্বারগুলোই হয়ে উঠেছে সংক্রামক রোগ বিস্তারের অন্যতম একটি মাধ্যম। ডেন্টাল সার্জন ডা. মো. শামীমুল আলম বলেন, দাঁতের চিকিৎসায় অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন। ভালো ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোয় অটোক্লেভ মেশিন, হট এয়ার ওভেন ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিকের সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে সাইডেক্স বা সমধর্মী কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে এলে খুব বেশি টাকা ব্যয় হয় না। কিছুটা সময় প্রয়োজন হয় আর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে অতিরিক্ত বেশ কয়েক সেট সরঞ্জাম থাকতে হয়। ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে এক-দুই সেট দিয়েই দিনের পর দিন কাজ চালিয়ে যান। ফলে রোগীর চাপ থাকলে জীবাণুমুক্ত করার সময় পান না। আবার নিম্নমানের ও একই সুচ অনেকদিন ব্যবহার করলে তা রোগীর মাড়িতে ভেঙে রয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে। এসব ব্যাপারে সচেতন থাকা চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব। খরচ একটু বেশি হলেও প্রয়োজনে রোগীকে বুঝিয়ে বলা উচিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (ডেন্টাল) ডা. উম্মে সালমা আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো সার্জারিতে সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে কাজ করার বিধান আছে। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন দফতর থেকে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখায় প্রমাণসহ কেউ লিখিত অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর