শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজশাহীতে বালুমহালের ৭৭ কোটি টাকা লোপাট

দুষ্টচক্রের দরপত্র জালিয়াতি, দুদকের তদন্ত দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহী জেলার বালুমহালগুলো ইজারাদানে দুষ্টচক্রের বছরের পর বছর দরপত্র জালিয়াতির ফলে গেল পাঁচ বছরে সরকারের রাজস্ব লোপাট হয়ে গেছে আনুমানিক ৭৭ কোটি টাকা। জেলা প্রশাসক অফিসের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সঙ্গে দুষ্টচক্রের আঁতাতের কারণে গোপনে ইজারা দেওয়ার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। তাই দেখা যায়, রাজশাহী নগরীর আশপাশের ১১টি ঘাট (বালুমহাল) ইজারা থেকে গত পাঁচ বছরে সরকারের রাজস্ব এসেছে মাত্র ৩ কোটি টাকা। সেখানে এবার এক মৌসুমের জন্য রাজস্ব আদায় হতে চলেছে ১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। বছরে ১৬ কোটি টাকা রাজস্ব ধরলে গত পাঁচ বছরে সরকারের আয় হতো ৮০ কোটি টাকা। অথচ হয়েছে ৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুষ্টচক্রের কারসাজির কারণে সরকারের হাতছাড়া হয়ে গেছে ৭৭ কোটি টাকা! পবার নবগঙ্গা-হাড়–পুর ঘাটটি ইজারা দিয়ে সরকারের কোষাগারে জমা পড়ে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর আগের কয়েক বছরেও একই হারে এ ঘাটটি ইজারা দেওয়া হয়। ওই ঘাটটিই এবার ইজারা নেওয়ার জন্য একই ব্যক্তি রাজশাহী মহানগরী আওয়ামী লীগের এক নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি রজব আলী দর দিয়েছেন ৫ কোটি ২ লাখ টাকা। শুধু রজব আলী নন, এ বছর রাজশাহীর প্রতিটি বালুঘাট এক লাফে লাখ থেকে কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে। সূত্র জানান, শুরু থেকে গোপনে বালুমহাল ইজারা দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন বালুমহাল দরপত্র কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক এস এম আবদুল কাদের। তিনি প্রকাশ্যে দরপত্র খোলার পক্ষে ছিলেন। তার আপত্তির কারণে এবার সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে বালুমহাল থেকে। তার কাছে সরকারের এই রাজস্ব ফাঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, তিনি কোনো অনিয়ম হতে দেননি। এদিকে, বছরের পর বছর বালুমহাল ইজারাদানে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের অনুসন্ধানের দাবি তুলেছেন সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা। তারা চান, দুদক এ ঘটনা তদন্ত করুক। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, পাঁচ বছরের ৩ কোটি আর এক বছরে ১৬ কোটি! এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে লুট করা হয়েছে। এটি অনুসন্ধানে দুদকের মাঠে নামা দরকার। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে নগরীসহ জেলার গোদাগাড়ী, বাঘা ও চারঘাট মিলে পদ্মা নদীর ১১টি ঘাট থেকে বালু উত্তোলনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের বাক্স খোলা হয় ৬ মার্চ।

যাচাই-বাছাই শেষে দেখা যায় ১৪২৫-২৬ মৌসুমের জন্য ১১টি বালুমহাল ইজারা নেওয়ার জন্য আগ্রহীরা ১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এর বাইরে ভ্যাট, আয়করসহ সরকারের কোষাগারে জমা পড়বে প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো। ইজারাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই দরপত্র জমাদানকারীরা এক বছরের জন্য ২০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট, আয়করসহ জমা পড়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ কোটি টাকা।

পবার মদনপুর, কসবা ও চরহরিপুর ঘাটটি গত বছর ইজারা দিয়ে সরকারের ঘরে জমা পড়ে মাত্র ৫ লাখ ১৮ হাজার ১০০ টাকা। এর আগের কয়েক বছরেও একই হারে এ ঘাটটি ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু এ ঘাটটি এবার আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি ইজারা গ্রহণের জন্য দর দিয়েছেন ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে ভ্যাট ও আয়কর। কিন্তু গত বছর এ ঘাটটি ছিল রাজশাহী মহানগরী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক বেন্টুর নামে। প্রায় তিন বছর ধরে বেন্টুর আওতায় ছিল এ ঘাটটি। এ ঘাটটি গোপনে ইজারা প্রদানের মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।

পবার চর খিদিরপুর ও চর শ্যামপুর ঘাটটি গত বছর ইজারা দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকায়। এর আগের কয়েক বছরও একই হারে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু এবার একই ব্যক্তি রাজশাহী মহানগরী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক বেন্টু দর দিয়েছেন ২ কোটি ২ লাখ টাকা। গত পাঁচ বছরে এ ঘাটটিও গোপনে ইজারা প্রদান করে সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা মিলে আছে আরও আটটি ঘাট। এ আটটি ঘাট মিলে এবার দর দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। কিন্তু এ আটটি ঘাট গত বছরে ইজারা দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকায়। এর আগের কয়েক বছরও গোপনে ইজারা দিয়ে সমপরিমাণ টাকা আদায় করেছে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দফতর। ফলে গত পাঁচ বছরে এ আটটি ঘাট ইজারা দিয়ে সরকারের ঘরে জমা পড়েছে ১ কোটি টাকার মতো। সে হিসাবে গত পাঁচ বছরে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।

এদিকে গত পাঁচ বছরে মোট কত টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে বালুমহাল থেকেÑ তা জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এভাবে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। তথ্য নিতে হলে আবেদন করতে হবে। আবেদন পেলে আমরা সে অনুযায়ী তথ্য দেব।’

সর্বশেষ খবর