বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলেও কাটেনি শোক

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক মাস

সাখাওয়াত কাওসার

প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলেও কাটেনি শোক

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কাল এক মাস পূর্ণ হলো। অগ্নিকান্ডের উৎপত্তিস্থল হিসেবে এরই মধ্যে বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা ‘ওয়াহিদ ম্যানশন’ ধ্বংসস্তূপ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে চুড়িহাট্টার মোড়ে। ভয়াবহ ট্র্যাজেডির এক মাস পর চুড়িহাট্টা এলাকায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলেও শোকের আবহ কাটেনি। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স আগুনের এ ঘটনা নিয়ে তাদের তৈরি তদন্ত প্রতিবেদন আজ জমা দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ওয়াহিদ ম্যানশনের দোতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র। এদিকে গতকালও ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচতলায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন সাদা পাঞ্জাবি পরা এক লোক। তার কান্না দেখে লোকের জটলা বেঁধে যায়। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তিনি বলতে থাকেন, ‘২০ ফেব্রুয়ারির আগে দুনিয়াটা ছিল নক্ষত্র আর এখন সমুদ্র হয়ে গেছে। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। কত কষ্ট পেয়ে ছেলে দুইটা চলে গেছে! যখনই মনে আসে সান্ত্বনা খুঁজতে এখানে ছুটে আসি।’ বার বার মূর্ছা যেতে যেতে মো. সাহেব উল্লাহ নামে ওই ব্যক্তি বলেন, ওয়াহিদ ম্যানশন ভবনের নিচতলায় ‘এমআর টেলিকম সার্ভিসিং সেন্টার’ নামের ওই দোকানে ব্যবসা করতেন তার দুই ছেলে মো. মাসুদ রানা ও মো. মাহবুবুর রহমান রাজু। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এখানে ব্যবসা খুলেছিলেন তারা। ৩৫ লাখ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও মালামাল মজুদ করা ছিল। ছেলেদের সঙ্গে সেগুলোও ছাই হয়ে গেছে। এখন তিনি পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন চান্দিরঘাটের একটি ভাড়া বাসায়। ছেলেদের মৃত্যুর পর দাফনের জন্য মাত্র ২০ হাজার টাকা করে পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে পুনর্বাসনের দাবি জানান তিনি। তার মতোই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওয়াহিদ ম্যানশনের বিপরীত পাশের মুশকিল কোষা হাউসের নিচতলার চা-দোকানি মো. আলমগীর। আগুনের ঘটনায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তার ছেলে মো. পারভেজ। ওই চা-দোকানিকে আগুনের কথা বলতেই খেপে গিয়ে বলেন, ‘এক মাস ধরে শুধু আশ্বাসের বিনিময়ে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। কী লাভ হইছে আমাদের!

 ছেলেকে হারিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। পুড়ে যাওয়া দোকানটিও ধার করে সংস্কার করা লাগছে। এখন ওই দেনা পরিশোধ করতে না পারলে পথে বসতে হবে।’

ফাল্গুন বেগম নামে এক স্বজন বলেন, অগ্নিকান্ডে তার ভাই অপু রায়হান, মো. আলী ও ভাতিজা আরাফাত মারা যান। এর পর থেকে প্রতিদিন নিজের ছেলেকে স্কুলে দিয়ে ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দুই ভাই ও ভাতিজাকে খোঁজেন তিনি। শুধু সাহেব উল্লাহ, আলমগীর কিংবা ফাল্গুন বেগমই নন, ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ডে পুড়ে মরা ব্যক্তিদের স্বজনরা প্রায় প্রতিদিনই ভিড় করেন চুড়িহাট্টায়। পোড়া স্তূপের মধ্যে খুঁজে ফেরেন স্বজনদের আর্তনাদ।

এদিকে অগ্নিকান্ডের প্রায় ১০ দিন পর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় চুড়িহাট্টার রাস্তা। আগের মতোই চলাচল বেড়েছে সাধারণ মানুষের। চলছে রিকশাও। সংস্কার করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান। ক্ষতিগ্রস্ত দুটি বাড়ির সংস্কার চলছে। তবে এখনো যায়নি পোড়া গন্ধ ও শোকের ছায়া।

গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, পোড়ার ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহিদ ম্যানশন। এটির দোতলায় এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাজার হাজার ঘাতক স্প্রের ক্যান। ভবনটির মূল গেটের অধিকাংশ দোকান পোড়া অবস্থাতেই আছে। দোকানগুলোর ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পোড়া বোতল, কেমিক্যালের কৌটা ও কার্পেট। চারতলা ভবনটি এখনো ঘোর অন্ধকার। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা অন্য ভবনগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই।

চুড়িহাট্টার ৬১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা রায়হান মেডিসিন কর্নারের মালিক মো. রায়হান বলেন, ‘ওই দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও চোখের সামনে কেয়ামত দেখেছি।’ ওয়াহিদ ম্যানশনের বিপরীত পাশের মান্নান স্টোরের কর্মচারী তানভির আহমেদ তুষার বলেন, ‘যে ঘটনার সাক্ষী আমরা হয়েছি, সেটি ভুলব কীভাবে? প্রথম ১৫ দিন ঘুমাতে পারিনি ভয় ও আতঙ্কে। এখনো চোখের সামনে ভাসে নির্মম এ ঘটনা।’

এদিকে এই ভয়াবহ ঘটনায় করা মামলায় সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত উল্লেখ করা হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক অধিদফতর ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা উল্লেখ করেছে। ইতিমধ্যে মামলার এজাহারনামীয় আসামি ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিক মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ হাই কোর্ট থেকে তিন সপ্তাহের জামিন পেয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক ও তদন্ত কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্মণ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডের কারণ হিসেবে ওয়াহিদ ম্যানশনের দোতলায় রাসায়নিক থাকার তথ্যই পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সব ভবন ও মার্কেটের তালিকা করে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজী ওয়াহিদ ম্যানশনে আগুনের ঘটনা ঘটে। এর পরই একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭০ জন মারা গেছেন। আহত ও দগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪১ জন। বর্তমানে ঢামেকে চিকিৎসাধীন আছেন শেখ মাহমুদ, সেলিম ব্যাপারি ও কাওছার হাওলাদার নামে তিনজন। ৭০ লাশের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে ৬৮টি। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মর্গে নেওয়া দুই নিহতের লাশ শনাক্ত হয়নি এখনো। তাদের জন্য আবার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। এখনো নিখোঁজ আছেন কামরাঙ্গীর চরের রিকশাচালক শাহাবুদ্দীন (৩৩), নিহত দম্পতি নাসরিন জাহান ও সালেহ আহমেদ লিপুর একমাত্র সন্তান আফতাহী (৭), সোয়ারীঘাটের রিকশাচালক হেলাল (৪৫) ও রফিক মিয়া (৩০) নামে চারজন। এই চারজনকে মৃত ধরে নিলে চুড়িহাট্টায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৪ জন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর