বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে গতকাল দেশের বিভাগীয় শহরগুলো থেকে ব্যাপক হাঙ্গামার খবর পাওয়া গেছে। এ সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষ ও উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন অফিস, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা এবং বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদকদের পাঠানো খবর -
খুলনা : খুলনায় গতকাল মহানগর আওয়ামী লীগ অফিস, জেলা পরিষদ, খুলনা প্রেস ক্লাব, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও সেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের পৈতৃক বাড়ি, সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুুল খালেকের বাড়ি, সংসদ সদস্য আবদুুস সালাম মুর্শেদীর অফিস-বাড়ি, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলামের বাড়ি, হোটেল-মার্কেটসহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের এসব ঘটনা ঘটে।
রাজশাহী : সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রুয়েটের সামনে জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অংশ নেন রাজশাহীর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও অভিভাবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সংহতি জানিয়ে আন্দোলন করেন।
রংপুর : রংপুরে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দিনভর উত্তেজনা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা সবাই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা হতে খন্ড খন্ড মিছিল এসে রংপুর টাউন হল সংলগ্ন সড়কে জমায়েত হতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাউন হল এলাকা লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অংশ নেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা প্রধান সড়ক অবরোধ করে সেখানে বিক্ষোভ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করলে শুরু হয় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। দুুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে জাহাজ কোম্পানি মোড়ে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
চট্টগ্রাম : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত এক দফা ‘অসহযোগ’ আন্দোলনে উত্তাপ, সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাধ্যমে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। আন্দোলনকারীরা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এদিন সকাল থেকে নিউমার্কেট এলাকায় জমায়েত করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। এতে নগরীর জিপিও, সদরঘাট রোড, স্টেশন রোড এবং আমতল এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষোভকারীরা যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। একই স্থানে মহানগর আওয়ামী লীগের জমায়েত কর্মসূচিতে যোগ দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এরই মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের যৌথ প্রতিরোধে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। ততক্ষণে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে জড়ো হন।
সিলেট : সিলেটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। চার সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। সকালে নগরীর কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর ১২টায় সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বেলা সোয়া ১টার দিকে সুরমা পয়েন্ট থেকে মিছিল নিয়ে কোর্ট পয়েন্টে আসে আওয়ামী লীগ।
বরিশাল : বরিশালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৭২ জন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বাসায় দুই দফা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বিএনপির কার্যালয়সহ দুদক, আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কার্যালয়সহ নগরের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়েছে। নিহত টুটুল চৌধুরী (৬০) নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। নগরের চৌমাথা এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় টুটুল চৌধুরীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নগরের নবগ্রাম রোডে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও সদর আসনের এমপি কর্নেল অব. জাহিদ ফারুকের বাসভবনে দুই দফা ভাঙচুর করে ও আগুন দেওয়া হয়। বাসার সামনে থাকা ২৫টির বেশি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বটতলা এলাকায় দুদক অফিসে ভাঙচুর ও আলেকান্দা পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলার চেষ্টা করা হয়েছে। সদর রোডে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। হামলাকারীরা অশ্বিনী কুমার হলের জানালার গ্লাস ভাঙচুর করেছে। নথুল্লাবাদ থেকে চৌমাথা পর্যন্ত সড়কের বেশ কয়েক জায়গাতে অ্যাম্বুলেন্সহ বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। পাশাপাশি এ সড়কের পাশে থাকা ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ কয়েক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
সংঘর্ষ চলাকালে নগরীর কোর্ট পয়েন্টে আহত হন চ্যানেল এস-এর সিলেট ব্যুরোপ্রধান মঈন উদ্দিন মনজু, দৈনিক যুগান্তরের আলোকচিত্রী মামুন হাসান। এ ছাড়া জিন্দাবাজারে আন্দোলনকারীদের হামলায় আহত হন একাত্তর টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার হোসাইন আহমদ সুজাদ ও ক্যামেরাপারসন তারেক আহমদ। এ সময় একাত্তর টেলিভিশনের ক্যামেরাও ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া আন্দোলনকারীরা দক্ষিণ সুরমার চন্ডীপুলস্থ সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করেন। এ সময় অফিসের সামনে রাখা বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন তারা।