ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব তার বিভাগের কর্মচারীদের জিম্মি করে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে বিভাগের কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। এই টাকার একটা অংশের ভাগ নিতেন সংস্থাটির সচিব আকরামুজ্জামান। পরিচ্ছন্নতা কর্মী, মশক কর্মী, পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক, সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনের (এসটিএস) ঠিকাদার, ক্লিনারদের বাসা বরাদ্দের নামে, ঠিকা ক্লিনার নিয়োগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সিন্ডিকেটে জিম্মি করে এসব টাকা আদায় করা হতো। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে এ রকম বিস্তর অভিযোগ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দুই দিন আগে দেশ ছাড়েন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ৬ আগস্ট থেকে করপোরেশনে আসেননি সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবদুল মোতালিব। বাসায় বসে কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বদলি হন সংস্থাটির আঞ্চলিক অফিস-৬ এ। সেখানেও ভয়ে নিয়মিত অফিস করছেন না। তার কারণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, ডিমোশনসহ অনেকের হয়রানি করেছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা আদায় করেছেন। এসব কারণে এই কর্মকর্তার ওপর ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা। ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে বিগত সময় সংস্থাটির মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সচিবসহ বিভাগের প্রধান বরাবর অভিযোগ করেছেন। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো সংস্থা বা নিজ দপ্তর তদন্ত করেনি। এই কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কমিশন দিয়ে ম্যানেজ করে বর্জ্য বিভাগের কর্র্র্র্র্মীদের জিম্মি করে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ৫ বছর এক চেয়ারে বসে হাতিয়েছেন ৫ কোটি টাকারও বেশি। অভিযোগ আছে, ডিএসসিসির সচিব আকরামুজ্জামান মাসিক নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিয়েছেন মোতালেবের কাছ থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৬৪ জন মশক পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করে। এসব কর্মীর মধ্যে ৪০ জনকে ছুটিতে রেখে দিতেন কর্মকর্তা মোতালেব। প্রতি কর্মী থেকে মাসে ৮ হাজার ও ৪০ জন থেকে মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করতেন। এ ছাড়া বাকি ২৪ জন যারা নিয়মিত কাজ করতেন তাদের কাছ থেকে অফিস খরচ বাবদ জনপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে মোট ১২ হাজার টাকা আদায় করতেন তিনি।
সংস্থাটির পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক রয়েছে ৭৫ জন। এর মধ্যে পুরাতন ওয়ার্ড ৫৭টি থেকে জনপ্রতি ১ হাজার ও নতুন ১৮ ওয়ার্ড থেকে ৫০০ টাকা করে মোট ৬৬ হাজার টাকা আদায় করতেন মোতালেব। প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তার নামে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের থেকে জনপ্রতি ২৫ টাকা করে ৪ হাজার ৮৫০ কর্মী থেকে মোট ১ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টাকা আদায় করতেন। এ ছাড়া প্রতি বছর এসটিএস (বর্জ্য রাখার স্থান) টেন্ডার দেয় সংস্থাটি। ঠিকাদাররা টেন্ডার পাওয়ার পর এই কর্মকর্তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে মোট ৬৬টি এসটিএস থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিতেন। এই বিভাগের গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করে ৪৫ জন। তাদের কাছ থেকে অফিস খরচ বাবদ ১৫০০ টাকা করে মোট ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা আবদুল মোতালেবের দপ্তরে জমা দিতে হতো। ৮৮৬ জন ঠিকা ক্লিনার নিয়োগ দিয়ে ২৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেন তিনি। এ ছাড়া ক্লিনারদের বাসা বরাদ্দের নামে ও পরিবহন বিভাগের ৮০ জন হেলপারকে চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে দেড় লাখ টাকাসহ মাসে হাতিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এদিকে এসব ঘুষের টাকার একটি অংশ সংস্থাটির সচিব মো. আকরামুজ্জামানকে দিয়ে ম্যানেজ করতেন আবদুল মোতালেব। এই সচিবের পৃষ্ঠপোষকতায় দাপুটে এবং ক্ষমতাশীল কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে জাহির করতেন মোতালেব ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, আবদুল মোতালেব পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ড্রাইভার ও হেলপারদের কাছ থেকে মাসিক কিস্তিতে টাকা নিতেন। কোনো কর্মীকে বাদ দিতেন না তিনি। সবার কাছ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিতেন। বর্জ্য বিভাগের ওয়ার্ড পরিদর্শকদের থেকেও মাসে ১ হাজার টাকা নিতেন মেয়র ও সচিবের কথা বলে। সব মিলিয়ে মোতালেব মাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা কর্মীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিতেন। করপোরেশনে বারবার অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সচিবের সহযোগী থাকায় তদন্ত করেনি করপোরেশন।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল দিলেও তারা রিসিভ করেননি।