বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র জমা দেওয়ার সময় তিন মাস বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, দরপত্রে আগ্রহ প্রকাশকারী কোম্পানিগুলোর অনুরোধেই এই সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, বৃদ্ধি করা সময়ে অর্থাৎ আগামী ৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই আগ্রহী কোম্পানিগুলো দরপত্র জমা দিতে পারবেন। এই সময়ের মধ্যে ভালো প্রস্তাব পাওয়া যাবে বলেও পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ আশা করছেন। এর পর আর দরপত্রের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে না। এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দরপত্র দাখিল করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সময় তিন মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমাদের কাছে সাতটি কোম্পানি দরপত্র নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এদের মধ্যে কেউ এককভাবে বিডিংয়ে অংশ নেবে আবার অনেকে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজ করতে আগ্রহী। সাধারণত ইউরোপ-আমেরিকায় জয়েন্ট ভেঞ্চারে এ ধরনের কাজ করতে গেলে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য সময় বেশি লাগে। বিডিং এ যারা অংশগ্রহণ করবে তারা আমাদের কাছে এজন্য বাড়তি সময় চেয়েছে। যেহেতু মোট সাতটি কোম্পানির এই দরপত্রে অংশগ্রহণ করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে এখন যদি দু-তিনটি কোম্পানি একত্রিত হয়ে কাজ করতে চায় সেক্ষেত্রে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোম্পানির সংখ্যা তিন থেকে চারে নেমে আসবে। তিনি আরও বলেন, আমরা নিশ্চিত যে কোম্পানিগুলো দরপত্রে অংশগ্রহণ করবে এর মধ্যে বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলোও আছে। আমরা ডিসেম্বরে দরপত্র খুলতে পারব। তবে এর পর আর দরপত্রের সময় বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। আসছে ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা ভালো কিছু প্রস্তাব পাব। যে বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিগুলো দরপত্র অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তার মধ্যে আছে এক্সন মবিল, শেভরন এবং ক্রিস এনার্জি।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে ‘অফশোর বিডিং ২০২৪’ আহ্বান করা হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গত ১০ মার্চ, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের আহ্বান করা হয়। সে সময় সাগরের ২৪টি ব্লকে অনুসন্ধান চালাতে এই দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত মে মাস পর্যন্ত সাতটি বিদেশি কোম্পানি বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র কেনে। দরপত্র ক্রয়ের জন্য গত ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। কিন্তু এই সময়ের পর পেট্রোবাংলা আবার তিন মাস বাড়িয়ে সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপ চালিয়ে গ্যাস পাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হওয়ায় দরপত্রে অংশ নিতে ৫০টির বেশি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর আগে সমুদ্রে গ্যাস প্রাপ্তির প্রাথমিক সম্ভাবনা যাচাই করতে জার্মানির কোম্পানি স্লামবার্জার বহুমাত্রিক জরিপ চালিয়েছে। এ ছাড়া কনোকোফিলিপসের পরিচালিত দ্বিমাত্রিক জরিপের তথ্যও আছে পেট্রোবাংলার কাছে। এতেও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের পিএসসি পৃথিবীর অন্যতম সেরা পিএসসির একটি। আমরা এই দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে আশাবাদী হতে চাই। সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এর আগে চারটি বিদেশি কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি চলে গেছে। ২০১২ সালে ভারতের সঙ্গে ও ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা-বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এখন গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে দুটি ব্লকে কাজ নেয় কনোকোফিলিপস। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপ চালালেও পরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। একইভাবে চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। অপরদিকে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসির তিনটি কূপ খনন করার কথা ছিল। এর মধ্যে একটি কূপ খনন করে গ্যাস পায়নি। আর বাকি দুটি কূপ খননের ব্যাপারে অবলিগেশন আছে। এর আগে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সব শেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল ২০১৬ সালে। ২০১৯ সালে নতুন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। প্রায় চার বছর পর গত বছরের জুলাইয়ে নতুন পিএসসি চূড়ান্ত অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ বাড়াতে এতে আগের চেয়ে সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এবার দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সনমবিল। তালিকায় আরও আছে দেশের গ্যাস উৎপাদন কাজে জড়িত আরেকটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটি মৌলভিবাজার ও হবিগঞ্জের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশে প্রতিদিন মোট গ্যাস উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে। এবার শেভরনও সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানে অংশ নিতে আগ্রহী। এরই মধ্যে শেভরন পেট্রোবাংলার কাছ থেকে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছে। নতুন করে আবার আগ্রহ দেখাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস। দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী চীনের কোম্পানি সিনোপ্যাকও।