রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

সমস্যার চাঁদপুরে আছে সম্ভাবনাও

পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া বিধৌত চাঁদপুরে অনেক বরেণ্য ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন। তিন নদীর মোলহেডে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের জন্য তৈরি হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘রক্তধারা’। এখানকার ইলিশ ইউরোপসহ পশ্চিমা অনেক দেশেই ‘চাঁদপুর ব্রান্ড’ পরিচিতি লাভ করেছে। সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্বও আদায় হচ্ছে। নদীমাতৃক চাঁদপুর ঘিরে গড়ে উঠতে পারে নানা পর্যটন শিল্প। এসব বিষয়, তথা চাঁদপুরের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জেলা প্রতিনিধি নেয়ামত হোসেন—

 

ফিরিয়ে আনতে হবে অতীত গৌরব

     —মোহাম্মদ হোসেন খান

এক সময়ের শিক্ষা-সংস্কৃতির লালনভূমি চাঁদপুর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছে তার ঐতিহ্য। জেলার সেই অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে

এখনই দরকার সমন্বিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এমনটাই জানালেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন খান। শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে যারা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে গেছেন তাদের অনকেই চলে গেছেন পরপারে। এদের মধ্যে ছিলেন— ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড চেয়ারম্যান আবিদুর রেজা চৌধুরী, শিক্ষাবিদ নওজোয়ান ওয়ালিউল্যাহ, শওগাত সম্পাদক নাছির উদ্দীন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমজাদ আখন্দ, ভাষা সৈনিক অ্যাড. আবুল ফজল, প্রথম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী জোহরা তারা, অধ্যক্ষ এডব্লিউএম তোয়াহা মিয়া, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, কমেডিয়ান দিলদার হোসেন প্রমুখ। যারা বেঁচে থেকে এ অঞ্চলের জন্য কাজ করে চলছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন— চিত্রশিল্পী হাসেম খান, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, বেগম পত্রিকার সম্পাদক নুরজাহান বেগম, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যাদের সুরের মূর্ছনায় শিল্পকলা একাডেমি মেতেছিল তাদের মধ্যে শীতল ঘোষাল, রুপালী চম্পক, কৃষ্ণা সাহা, অনুপ সাহা, এসডি রুবেল, মনির খানের জন্ম এ চাঁদপুর।

 

সুন্দর নগরী গড়তে চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা

     —মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

চাঁদপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি ও দর্শনীয় স্থান। এখানে মোটেল ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে দর্শনার্থী আরো বাড়বে। এতে

করে বিভিন্ন নান্দনিক ও শৈল্পিক ব্যবসার প্রসার ঘটবে বলে জানান, শিল্পোদ্যোক্তা ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সমবায়ী মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, চাঁদপুরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে লোহাগড় মঠ, রুপসার জমিদার বাড়ি, মাদার খাঁ মাজার ও ঐতিহাসিক বড় মসজিদ, অলিপুরের আলমগীরি ও শাহ সুজা মসজিদ, সাচারের রথ, শাহ (রহ.)’র মাজার কমপ্লেক্স, ফরাজীকান্দি বোরহানউদ্দিন (রহ.)’র আল-ওয়াইসিয়া কমপ্লেক্স উল্লেখযোগ্য। এসব পুরার্কীতিতে যাতায়াত, আবাসিক সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। এজন্য জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি বিনিয়োগকারী ও প্রশাসনের এগিয়ে আসা দরকার। এক সময় ধান উৎপাদনের কেন্দ বিন্দু ছিল চাঁদপুর ও মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প। সেই প্রকল্পগুলোতে বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করা, বাঁধ ও ক্যানেলগুলো সংস্কার হলে দেশের খাদ্য উৎপাদনে এ জেলা আবার বিপ্লব ঘটাবে। মেঘনার মোলহেডকে ঘিরে গড়ে তোলা যেতে পারে পর্যটন শিল্প। স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল জনগোষ্ঠী এই স্থানটিতে সূর্যাস্ত ও লঞ্চ চলাচল দেখতে জড়ো হন। এসব বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ও প্রবাসীদের বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে।

 

নৌ ও সড়কপথের দ্রুত উন্নয়ন ঘটাতে হবে

     —সুভাষ চন্দ্র রায়

চাঁদপুর বিসিক শিল্প নগরীতে রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে। শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। এ

জেলার রেলপথের উন্নয়ন ঘটলেও সম্ভাবনাময় নৌ-বন্দরটির দিকেও নজর দিতে হবে। চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সুভাষ চন্দ  রায়ের মতে, বন্দরটির উন্নয়ন ও নৌ-চ্যানেল ড্রেজিং করা হলে নৌরুট হতে পারে এ অঞ্চলের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ফলে চাঁদপুরের উৎপাদিত পণ্য কম খরচে পরিবহন করা যাবে। চাঁদপুর-মতলব-দাউদকান্দি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদে (একনেক) পাস হওয়া প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প সড়কের খানাখন্দ সংস্কার ও বাঁকগুলো কমিয়ে এনে জুনের মধ্যে শেষ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে মতলবে দুটি সেতুর নির্মাণ কাজ। পর্যটন নগরীর জন্য রাজরাজেশ্বর, ষাটনল ও হাইমচরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি পর্যটন মেলা করে আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক এ ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হরিনা-শরীয়তপুর ফেরি সার্ভিস এলাকায় ব্রিজ হলে চট্টগ্রাম-খুলনা-যশোর-মাদারীপুর অতি সহজে ও কম খরচে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত করতে পারবে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় জেলার ৩৩টি লবণ শিল্পের মাত্র তিনটি চলমান এতে বেকার হয়ে পড়েছেন বহু শ্রমিক

 

নিরাপদ পানির শহর চাঁদপুর

     —নাছির উদ্দিন আহম্মদ

১২০ বছরের চাঁদপুর শহরে বর্তমানে দুই লাখ লোকের বাস। দ্রুত বর্ধনশীল শহরের মধ্যে চাঁদপুর একটি। দুর্নীতিমুক্ত পৌরসভার

অনন্য দৃষ্টান্ত চাঁদপুর পৌরসভা। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে শহর গড়ে উঠায় রাস্তাগুলো সরু হয়ে পড়েছে। আট কিলোমিটার সড়ক বর্তমানে সম্প্রসারিত হয়েছে ২২ কিলোমিটারে। পরিকল্পিত নগরায়ণে করা হয়েছে মাস্টার প্ল্যান। ইতোমধ্যে ২৫ বছরের পরিকল্পনার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর সুফলও ভোগ করতে শুরু করেছেন জনগণ। নানা দিক থেকে পৌরসভাটি অনেক এগিয়ে থাকলেও পাড়ি দিতে হবে আরও বহু পথ। এমন মত প্রকাশ করেছেন চাঁদপুর পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহম্মদ। তিনি জানান, চাঁদপুর পৌরসভাকে নিরাপদ পানির শহর হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খুব শিগগিরই ঘোষণা করবে। বর্তমানে নগরীর মূল সমস্যা ড্রেনেজ ও যানজট। রাস্তা প্রশস্ত কি করে সম্ভব তাও বিবেচনায় রয়েছে। শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বিশালকার লেক দুটি রক্ষায় পরিকল্পনা আছে। এক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদেরও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। চাঁদপুরকে এক সময়ে ইস্টার্ন গেটওয়ে বলা হতো। চাঁদপুর নৌ-বন্দরের সেই হারানো ঐতিহ্য ও ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটানোর জন্য পুনরায় পশ্চিম ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। তখন এখানে সৃষ্টি হবে শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ।

সর্বশেষ খবর