রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজশাহীতে সাঁওতাল পল্লী জবরদখলের পাঁয়তারা

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

সুকল টুডু ও আসিন মার্ডি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বাঁশবাড়ী গ্রামের সাঁওতাল পল্লীতে। কিন্তু তাদের আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে, কবে যে তাদের সেই বসতভিটা জবরদখল হয়ে যায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লীর দরিদ্র কৃষকদের জমির মালিকানা দাবি করে দীর্ঘদিন হেনস্থা করে আসছেন এলাকায় যিনি আবদুস সামাদ ওরফে মুসা নামে পরিচিত। জবরদখলের মতলবে কয়েকদিন আগে মুসা সরকারদলীয় গুটিকয়েক নেতার সঙ্গে আঁতাত করে সাড়ে তিন একর জমিতে খুঁটি গেড়েছিলেন। মুসার নামে আছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। এলাকার অনেক মানুষকে নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লীর জমি দখল চেষ্টার পর এখন সেই অভিযোগও সামনে চলে এসেছে। আবদুস সামাদ মুসা উপজেলা সদরে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তার দাবি, সাঁওতাল পল্লীর লোকেরা ১৯৬৪ সালে এক বিনিময় দলিলের মাধ্যমে তার মা সোহাগী বিবি ও বাবা হাজী আব্বাস মালিথাকে ওই জমি দিয়ে ভারত চলে যায়। এটি তার পৈতৃক সম্পত্তি। তার সব কাগজপত্রও আছে। তিনি খাজনাও পরিশোধ করেছেন। তবে সাঁওতালদের দাবি, ওই বিনিময় দলিল পরে বাতিল করা হয়েছিল। ওই পল্লীতে ১২টি পরিবারের বসবাস। পল্লী প্রধান নরেশ মার্ডি জানান, ১৯৬৪ সালে এক বিনিময় দলিলের মাধ্যমে আবদুস সামাদের মা ও বাবার নামে ১৫২ বিঘা জমি লিখে দিয়ে সাঁওতাল পল্লীর লোকজন ভারতে চলে গিয়েছিল। এ ঘটনা সত্য। কিন্তু পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা ও মানুষকে নির্যাতনের কারণে মুসার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যায়। সেখানে গিয়ে তারা আর বাংলাদেশে থাকতে পারছে না উল্লেখ করে বিনিময় দলিল বাতিলের প্রস্তাব দেয়। এতে সাঁওতালরা রাজি হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, ভারতের বহরমপুর আদালত ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ বিনিময় দলিল বাতিল করেন। এরপর সাঁওতাল পল্লীর লোকজন আবার পৈতৃক ভিটায় ফিরে আসেন। আর আবদুস সামাদ মুসার পরিবারের সবাই ভারত চলে যায়। কিন্তু এরশাদের শাসনামলে দেশে এসে বিনিময় দলিল বাতিলের বিষয়টি গোপন করে মুসা ওই জমি বিক্রির চেষ্টা করেন। সাঁওতালদের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি শুরু করেন। নরেশ মার্ডি আরও জানান, ভুলবশত ওই জমি সরকারের ‘খ’ তফসিলভুক্ত হয়। এর বিরুদ্ধে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়। এখন এ জমির খাজনা দেওয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। বাঁশবাড়ী এলাকার রূপচাঁন (৭৫) বলেন, ‘আমার চোখের সামনে মিলিটারিকে নিয়ে এসে মুসা বদিউজ্জামান, আনিস খলিফা ও ইসমাইল খলিফাকে হত্যা করে পাশের বাঁশঝাড়ে পুঁতে রাখে। এলাকার মফিদুল ইসলাম জানান, এ এলাকার হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর হামলার প্রতিবাদ করায় ইসমাইল খলিফাকে হত্যা করেছিল মুসা। ওই সময় এলাকায় ব্যাপক লুটপাটও চালিয়েছিল মুসা। পল্লীতে বসবাস করা মুনমুনি মার্ডি বলেন, ‘সামাদ ভারতে গিয়ে বলল, আমরা ওখানে আর থাকতে পারছি না। তোমরা তোমাদের জায়গায় চলে যাও। তখন আমরা চলে আসি। এরশাদের আমলে মুসা সেনাবাহিনীর লোক নিয়ে এসে আমাকে এত মেরেছিল যে, আমার ডান চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার আমাদের জমি জবরদখল করতে আসছে।’ পুঠিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, সাঁওতাল পল্লীর জায়গা দখলের চেষ্টার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হলে তিনি তাদের সহায়তা করবেন বিচারের জন্য। তবে একাত্তরে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ও জমি দখলের চেষ্টার কথা অস্বীকার করেছেন আবদুস সামাদ মুসা। তিনি বলেন, ‘আমি ওই পল্লীর জমি দখলের জন্য কোনো লোক পাঠাইনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো খুন-খারাবিও করিনি। ওই জমি আমার পৈতৃক।’ এদিকে শুক্রবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৌভিক রেজা, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সারোয়ার জাহান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজী মামুন হায়দার, ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক আমিরুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সাঁওতাল শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা সাঁওতাল পল্লীতে যান। এ সময় পল্লীর লোকজন নানা অভিযোগ করেন।

সর্বশেষ খবর