বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

সমস্যার নড়াইলে সম্ভাবনাও অনেক

চিত্রা-মধুমতি-নবগঙ্গা বিধৌত শিক্ষা-সংস্কৃতির জেলা নড়াইল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এ জেলা। নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা নড়াইলে অফুরন্ত সম্ভাবনাও রয়েছে। বিসিক নগরী গড়ে তোলা, উন্নত যোগাযোগ ও অবকাঠামো স্থাপন করে এখানে অর্থনৈতিক ও পর্যটন জোন করার দাবি জেলাবাসীর। নড়াইলের নানা সমস্যা, তা সমাধানে করণীয় নিয়ে বিশিষ্টজনের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি সাজ্জাদ হোসেন—

 

বিসিক নগরী প্রয়োজন

—হাসানুজ্জামান

যে কোনো জেলার অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার অন্যতম চাবিকাঠি শিল্প-কারখানা। অথচ নড়াইলে আজও গড়ে উঠেনি কোনো বিসিক নগরী। ফলে হতাশ স্থানীয় উদ্যোক্তারা। বিসিক নগরী না থাকা নড়াইলের উন্নতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় বলে মনে করেন জেলা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. হাসানুজ্জামান। তিনি জানান, দক্ষিণাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। এ সেতুর চালু হলে এশিয়ান হাইওয়ে ও ঢাকা-কলকাতা রেলপথ নড়াইলের উপর দিয়ে যাবে। তখন এ জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব হবে মাত্র ১২০ কিলোমিটার। আর বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল এ অঞ্চলে সহজলভ্য। এ কারণের ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনার পর নড়াইল হতে পারে শিল্প-কারখানার সম্ভাবনাময় এলাকা। এ অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, ব্যাংকঋণের সুদের হার ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধক। সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনলে ব্যবসার গতি বাড়বে। সরকার এ বিষয় নজর দিয়ে বিসিক নগরী করলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা হতাশা কাটিয়ে শিল্পায়নে আগ্রহী হবেন। তিনি বলেন, নড়াইল দীর্ঘদিন অবহেলিত। ধীরে ধীরে এই বলয় থেকে বের হচ্ছে। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চল ঘিরে যে অর্থনৈতিক জোনের সৃষ্টি হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে নড়াইলসহ এ অঞ্চল সিঙ্গাপুরের মত পরিচিতি লাভ করবে।

 

উন্নয়নের অন্তরায় অনুন্নত যোগাযোগ

—শহীদুল ইসলাম

কৃষিভিত্তিক জেলা নড়াইল। কৃষিতে নানা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সদর থেকে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতে সময় বেশি লাগে। ফলে কৃষিপণ্য দ্রুত সরবরাহ করতে না পারায় ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। যা কৃষিখাতে উন্নতির অন্যতম বাধা বলে মনে করেন কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন— নড়াইলের অধিকাংশ খাল পলি জমে ভরাট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দ্রুত খালগুলো পুনঃখনন প্রয়োজন। খাল ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় নদীর লবণাক্ত পানি জমিতে ঢুকে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এতে দিন দিন উৎপাদন কমে যাচ্ছে। যা-ও ফসল ফলছে তার আবার ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎসাহ হারাচ্ছেন কৃষক। শহীদুল ইসলাম জানান, নড়াইল থেকে শস্য জেলার চাহিদা পূরণ করে অন্যত্র রপ্তানি হয়। জেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ হয় প্রচুর সবজি। নড়াইলের পান যায় বিদেশেও। অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় অনেক সময় চাষিরা পান বিক্রিই করতে পারেন না। নড়াইল-ঢাকা সড়কের কালনা সেতু চালু হলে কৃষক পচনশীল পান সহজে বাজারজাত করতে পারবেন। এতে পান চাষীদের পাশাপাশি অন্যরাও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হবেন।

 

চাই পরিকল্পিত নগরায়ন

—এসএ মতিন

নড়াইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা ডিপুটি কমান্ডার ও পরিবেশবিদ এসএ মতিন বলেন— নড়াইল-ফুলতলা-খুলনা হয়ে কালনা সড়ক সংস্কারের নামে প্রতি বছর নানা দুর্নীতি হচ্ছে। জয় বাংলা শ্লোগানের চেতনা ধারণ করে বন্ধ করতে হবে এ দুর্নীতি। এ পরিবেশবিদ জানান, নড়াইল আমাদের আন্দোলনের ফসল। এখন এটিকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের। এ জন্য শুরু থেকে পরিকল্পিতভাবে নগরায়ন প্রয়োজন। এখান থেকে প্রতিটি জেলার সঙ্গে যোগাযোগের সড়ক চার লেনে করতে হবে। নড়াইলে একটি মেডিকেল কলেজ, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ দরকার। এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা, একাত্মতা। কোনো একটি অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য জনপ্রতিনিধিদের বিকল্প নেই। তারা দেশের জন্য চিন্তা করবেন। দোষ-ক্রুটি সবারই থাকে। এ জন্য চাই সৎ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক নেতা। নড়াইলে এই পর্যায়ের রাজনীতিকের বড় অভাব। এসএ মতিন জানান, ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার এ অঞ্চলের সর্বশেষ মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ নওশের আলি। এরপর আর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্ত্রী হতে পারেন নাই। নড়াইলে দ্রুত উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে এ বিষয়টিও কাজ করছে। তারপরও কালনা সেতু হলে এ অঞ্চল কিছুটা অগ্রসর হবে।

 

নড়াইল হতে পারে পর্যটন এলাকা

—আজিজুল ইসলাম

নড়াইলের হাটবাড়িয়া ও নড়াইল শহরস্থ জমিদার বাড়ি, চিত্রা নদীর তীরে বাঁধা ঘাঁট, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মাদের স্মৃতি সংগ্রহশালা, চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বাড়িসহ বহু দর্শনীয় স্থান পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। প্রত্নতত্ত্বভিত্তিক এসব স্থাপনা সংস্কার করে পর্যটন জোন ঘোষণা করলে এখানে খুলে যাবে পর্যটন শিল্পের নতুন দ্বার। এমনটাই মনে করেন নড়াইলে তরুণ আইনজীবী মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, লোহাগড়ার ইটনা জমিদার বাড়ি, কালি শংকরের পুকুর, রবি শংকরের বাড়ি, সেন বাড়ি আজ বিলুপ্তির পথে। হুমকির মুখে ঐতিহ্যবাহী কুরির ডোব বা ওয়ালিংটন মাঠটির অস্তিত্ব। কলাকাতার ইডেন মাঠের আদলে তৈরি বিশাল এই মাঠে একসঙ্গে দুটি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতে পারতো। শুড়কি-বালি বিছিয়ে মাঠটি এমনভাবে তৈরি করা যেখানে কখনো কাদা জমে না। নানাভাবে ক্রমেই গ্রাস হচ্ছে মাঠটি। এ আইনজীবীর মতে, সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের পুরাতন সাইন্স ভবন, বৃটিশ ভারতের বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের একমাত্র হাসপাতাল যা বর্তমান ট্রাফিক পুলিশের ব্যারাক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে-এগুলোকে পর্যটন জোন করে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এতে সরকারের রাজস্ব যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি নড়াইল হবে পর্যটকদের আকর্ষণীয় জায়গা।

সর্বশেষ খবর