শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

অর্থনীতিতে অবদান রেখেও উপেক্ষিত নারায়ণগঞ্জ

প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জ। ব্যবসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেক্টরে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ব্রিটিশ সরকারের আমল থেকেই রাখছে এ জেলাটি। কিন্তু নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতায় দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে এখানকার শিল্প-প্রতিষ্ঠান। বলা যায়, অবিস্মরণীয় অবদান রেখেও অবহেলিত নারায়ণগঞ্জ। এ জেলার নানা দিক নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রোমান চৌধুরী সুমন—

 

অসাধুরা ক্ষতিগ্রস্ত করছে সুতা শিল্প

—লিটন সাহা

বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়ে-শনের সভাপতি লিটন সাহা বলেন, সুতার বৃহত্তর বাজার নারায়ণগঞ্জ। জেলা শহরের টানবাজারেই মাসে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সুতা বিক্রি হয়। এই বাজারকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্পিনিং মিল। কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে স্পিনিং মিল ও সুতা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব। অসাধু ব্যবসায়ীরা কৌশলে বন্ডের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সুতা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আমদানি করছেন। অতিরিক্ত এ সুতা বাজারে বিক্রিও হচ্ছে অবৈধ পন্থায়। এতে দেশে উৎপাদিত সুতা বিক্রিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এ শিল্পে বিনিয়োগকারীদের। এ ব্যবসায়ী নেতা জানান, দেশের স্পিনিং মিলগুলো সুতার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হলেও থেমে নেই অসাধুদের বন্ডের মাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আমদানি। লিটন সাহার মতে, বন্ড সুুবিধার অবৈধ ব্যবহার রোধ করতে পারলে দেশের স্পিনিং মিল ও সুতা ব্যবসায়ীরা আরও স্বাবলম্বী হবেন। বর্তমানের তুলনায় ভবিষ্যতে দিগুণ হবে দেশীয় সুতা বিক্রি। এতে এ পেশায় জড়িত ব্যবসায়ী, মালিক ও শ্রমিক মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন।

 

দরকার সরকারি সহযোগিতা

—নাজমুল আলম সজল

ব্যবসা ক্ষেত্রে তিনটি সুুবিধা পেলেই নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি শিল্পপণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হবে। ফলে দেশের শিল্পক্ষেত্রে যুগোপযোগী অবদান রাখতে পারবে এ জেলা। এমন মন্তব্য— নারায়ণগঞ্জ হোসিয়ারি সমিতির সভাপতি নাজমুল আলম সজলের। তিনি বলেন, গত তিন বছরের দুই বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে শিল্পটি। চলতি বছর শীতের প্রকোপ না থাকায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এ শিল্পে উৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হয়। কিন্তু বিভিন্ন আন্দোলনে পরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্য বিক্রি করতে না পারায় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সংশ্লিষ্টদের। নাজমুল আলম জানান, হোসিয়ারি শিল্পের ব্যাপক প্রসারের লক্ষ্যে সরকারে থেকে সহজ পন্থায় শ্রমিকদের ৬-৭ লাখ টাকা ঋণ দিলে তারাও কারখানা মালিক বনে যেতে পারবেন। এতে গড়ে উঠবে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান-উৎপাদন। তার মতে, এই শহরের তিনটি স্থান থেকে হোসিয়ারি শিল্প সরিয়ে একটি বিশাল জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়া প্রয়োজন। এতে সব হোসিয়ারি ব্যবসায়ী একত্রে শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন।

 

অবহেলায় রুগ্ন হচ্ছে পরীক্ষিত শিল্প

—মাহমুদুর রহমান সুুমন

অবহেলা-উদাসীনতায় দেশের অর্থনৈতকি উত্থানে অবদান রাখা কয়েকটি ক্ষুদ্রশিল্প রুগ্ন হয়ে পড়েছে বলে জানান আড়াইহাজারের বাসিন্দা বাংলাদেশ ও গ্রিস চেম্বার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল সেক্রেটারি মাহমুদুর রহমান। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের তাঁত শিল্পের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যে শিল্পটি ব্রিটিশ আমলেও এদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল সেটি আজ ধুঁকছে। আড়াইহাজারে অর্ধলক্ষাধিক তাঁত শিল্প ছিল এক সময়ে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব বিপন্নের পথে। মাহমুদুর রহমান জানান, তাঁতপণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ঐতিহ্য হারাচ্ছে শিল্পটি। এ শিল্পের প্রাণ ফেরাতে প্রয়োজন তাঁত শিল্পীদের সরকার থেকে সহজশর্তে ঋণ প্রদান। এ ছাড়া বন্দর উপজেলার পানগাঁও পোর্টটি সরকার পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিলে ব্যবসা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। তার ভাষ্য, এক সময় এই পানগাঁও পোর্ট ব্যবহার করে ব্রিটিশ সরকার নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাতিতে ভূষিত করে। সেই পোর্ট এখন ভুতুড়ে পরিবেশ। এগুলোর দিকে সরকারের সুুনজর পড়লে নারায়ণগঞ্জ ব্যবসা ক্ষেত্রে বিশ্ব দরবারে খ্যাতি অজর্ন করবে।

 

দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে নিট সেক্টর

—মোহাম্মদ হাতেম

গার্মেন্ট নিট শিল্পে দেশের প্রায় ১৩ বিলিয়ন  বিদেশি অর্ডারের অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে ৬-৭ বিলিয়ন নিট পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। এতে হাজার কোটি ডলার মুনাফা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে এ জেলা। কিন্তু নিট শিল্প নানা বাধার কারণে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না বলে অভিযোগ করেন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি জানান, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী নিট সেক্টরকে নানা প্রণোদনা দিয়ে সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু এই সুুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়নে যে কর্তৃপক্ষ রয়েছেন তারা নানা কৌশলে প্রণোদনায় আইনি মারপ্যাঁচ দিয়ে অর্থ লোপাট করছে। একই সঙ্গে স্থানীয় রাজস্ব অধিদফতর বিভিন্ন সময় আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে রপ্তানিকারকদের চাপের মুখে ফেলে অবৈধ পন্থায় হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। এতে আতঙ্কে রয়েছে দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী নিট সেক্টরের রপ্তানিকারকরা। এ ব্যবসায়ী নেতা জানান, দেশে বিদেশি অর্ডারের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অভিজ্ঞ শ্রমিক বাড়েনি। শ্রমিক সংকট নিরসনে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেকারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ সেক্টরে নিয়োগ বাড়াতে হবে।

সর্বশেষ খবর