রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নানা সমস্যায় অস্তিত্ব সংকটে কুড়িগ্রামের পাটনিরা

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

একসময় নদীতে খেয়াঘাটে মানুষ পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করত কুড়িগ্রামের পাটনি সম্প্রদায়। কালের বিবর্তনে খেয়াঘাটগুলো সরকারিভাবে ইজারা দেওয়ায় দিনে দিনে এ পেশা হারাতে হয়েছে তাদের। এখন অনেকের বাস্তুভিটাটুকুও নেই। নেই লাশ সৎকারের জায়গা। রাস্তার পাশে খাস জমিতে বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে জীবনযুদ্ধে কোনোরকমে টিকে আছে দলিত সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের পাশে বসবাস করছে অর্ধশতাধিক পাটনি পরিবার। বাপ-দাদার পেশা হারিয়ে বাঁশ ও বেতের তৈরি ডালি, কুলা, ডুলি, চালনিসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি আসবাব তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে চাহিদা কমে আসছে তাদের তৈরি পণ্যের। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোরকমে চলছে সংসার। এ অবস্থায় নতুন সংকট তৈরি হয়েছে মৃত্যুর পর লাশের সৎকার নিয়ে। এতদিন অন্যের জমিতে সৎকারের ব্যবস্থা থাকলেও এখন তাও নেই। লাশ নিয়ে নামতে হচ্ছে রাস্তায়। ফলে এ সম্প্রদায়ের মানুষের চাওয়া— জীবনের শেষ ঠিকানার জন্য নির্দিষ্ট একটু জায়গা। কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের বাজার সংলগ্ন পাটনি সম্প্রদায়ের রমেশচন্দ্র অধিকারী বলেন, ২০ বছর আগে কাঁঠালবাড়ীতে পাটনি সম্প্রদায়ের আলাদা গ্রাম ছিল। ৪ শতাধিক লোকের বাস ছিল। তখন নদীর ঘাটে ইজারা হতো না। বাপ-দাদারা খেয়াঘাটে নৌকা দিয়ে লোক পারাপারের কাজ করে উপার্জন করতেন। কিন্তু এখন তাদের সে পেশা কেড়ে নিয়েছেন বিত্তবানরা। অন্য জাতের মানুষ নৌকা দিয়ে লোক পারাপার করাচ্ছে। প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে না পারায় পেশা বদলাতে হয়েছে তাদের। পেশা বদলিয়েও যান্ত্রিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না অনেকে। পাটনি সম্প্রদায়ের গণেশ জানান, ‘এখন তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। থাকার জায়গা নেই। কারও মৃত্যু হলে লাশ সৎকারের জায়গা পাওয়া যায় না। আগে শ্মশানঘাট ও কবরস্থান কলেজ তৈরি হয়েছে। মানুষ বেড়ে যাওয়ায় বাড়িঘরও বেড়েছে। এজন্য এখন কেউ আমাদের লাশ পোড়ানো বা কবর দেওয়ার জায়গা দেয় না। ২২ নভেম্বর আমার দাদি মারা গেলে তাকে পোড়ানো বা কবর দেওয়ার জায়গা পাইনি। ফলে আমাদের সম্প্রদায়ের সবাই মিলে লাশ নিয়ে রাস্তা অবরোধ করতে হয়েছে। পরে পুলিশ ও চেয়ারম্যান এসে লাশ পোড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন আমরা সরকারের কাছে মৃত্যুর পর শেষ ঠিকানাটুকু দাবি করছি। সরকার যেন শ্মশান বা কবরস্থানের একটু জায়গা দেয়।’ একই পাড়ার করেন জানান, খেয়াঘাটের ইজারা বিত্তবানদের হাতে চলে যাওয়ায় আদি পেশা মাঝি-মাল্লার কাজ ছেড়ে দিয়ে বউ-বাচ্চা মিলে বাঁশ-বেতের গৃহস্থালি পণ্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। কিন্তু এ পেশাও ভালো চলছে না। তাই অতিকষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে। পাটনিপাড়ার বিশ্বকা রানী ও সরস্বতী জানান, ‘জীবন-জীবিকায় নানা কষ্ট থাকলেও তা মেনে নিয়ে মৃত্যু-পরবর্তী সৎকারের একটু জায়গাই এখন একমাত্র কাম্য আমাদের। আমরা তো এ দেশেরই নাগরিক। মৃত্যুর পর শান্তিতে ঘুমানোর জায়গাটুকুর ব্যবস্থা যেন সরকার করে দেয়। আমাদের লাশ সৎকারের জন্য যেন আর রাস্তায় নামতে না হয়।’

সর্বশেষ খবর