মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়ায় বসেছে বাউলের হাট

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

‘অনেক দিন ধরেই ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াই দেশে দেশে। তবে কীভাবে তাকে পাব বুঝতে পারছিলাম না। শেষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়া বাড়ি এসে আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পেলাম। জানতে পারলাম সহজ মানুষ হতে হবে, মানুষকে বুঝতে হবে, ভালোবাসতে হবে। তবেই মিলবে ঈশ্বরের সন্ধান। এরপরই লালন সাঁইয়ের গুরুবাদী ধর্মে দীক্ষিত হলাম।’ বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১২৭তম তিরোধান দিবসের উৎসবে আখড়া বাড়িতে এসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় এসব বলছিলেন ফ্রান্সের তরুণী দেবোরা।

গতকাল সন্ধ্যায় দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ।

বাংলা ১২৯৭ সালের পয়লা কার্তিক সাধক পুরুষ লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। লালন মাজারের খাদেম মুহাম্মদ আলী বলেন, সাঁইজি তার মৃত্যুর বিষয়টি আগে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই আশ্বিনের শেষ সপ্তাহে তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘১ কার্তিক তোমরা কোথাও যেওনা, ওই দিন গজব হবে।’ ১ কার্তিক রাতে সাঁইজি খাওয়া-দাওয়া শেষে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে গান ধরলেন, ‘পারে লইয়ে যাও আমায়, ওহে দয়াময়’। শিষ্যরা তন্ময় হয়ে গুরুর গান শুনছিলেন। এরই মাঝে সাঁইজি        দেহত্যাগ করেন।

এরপর থেকে লালনের অনুসারীরা প্রতি বছর ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ দিনটি পালন করে আসছেন। তবে লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর এ আয়োজনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনের অনুষ্ঠান।

এই উৎসবের কোনো দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও এক উদাসী টানে মানুষ ছুটে এসেছেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। যেখানে মিলন ঘটেছে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। কেউ এসেছেন ধবধবে সাদা পোশাকে, আবার কেউ গেরুয়া বসনে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদেরও ভিড় লেগেছে। ‘বাড়ির পাশে আরশীনগর, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহী আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’ এ রকম অসংখ্য লালন সংগীতের সুরের মূর্ছনায় তারা মাতিয়ে তুলেছেন বাউল ধাম। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করছেন গানে গানে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও। দূর-দূরান্ত থেকে সাদা বসনে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে। একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে। ক্ষণে ক্ষণেই খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে নৃত্যসংগীতের তালে তালে ছলকে উঠছে যেন উত্তাল ভাববাদী ঢেউ। কেউ শুধু লুঙ্গি পরে নাচছেন, গাইছেন। কারও উদাম গা। গলায় বিচিত্র বর্ণ ও আকারের পাথরের মালা। হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি ও বাদ্যযন্ত্র। লালন ধামের ভিতর ও বাইরে নিজেদের পছন্দমতো জায়গা করে নিয়ে গান-বাজনা করছেন তারা। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তুলছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। আখড়ার একটি দল থামছে তো অন্যটি জমিয়ে রাখছে চারপাশ।

লালন ধামের ভিতর ষাটোর্ধ্ব বাউল এনাম শাহ তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির গুণকীর্তন করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভিতর আধ্যাত্মবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। এনাম শাহ বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন, নাচতেন। তিনি বলেন, কোনো এক অচিন গাঁয়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন এখানে বসেই জীবনভর সন্ধান করেছেন, অচিন পাখির সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান।

সর্বশেষ খবর