২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ২০:৩৩

ট্রলারডুবিতে নিহত শ্রমিকদের বাড়িতে শোকের মাতম

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:

ট্রলারডুবিতে নিহত শ্রমিকদের বাড়িতে শোকের মাতম

নারায়ণগঞ্জে মাটিবাহী ট্রলারডুবিতে নিহত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তিনটি গ্রামের ৬ শ্রমিকের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বৃহস্পতিবার ভোরে ৬ জনের লাশ গ্রামে পৌঁছলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তিনটি গ্রামের মানুষ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। স্বজনদের হারিয়ে বার মুর্ছা যাচ্ছেন কারও স্ত্রী, কারও মা, কারও সন্তান কিংবা কারও বাবা। ছোট ছোট শিশুরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল প্রিয় বাবার মুখের দিকে। স্বজনের বুকফাটা আর্তনাদে পুরো এলাকা শোকে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। নিহতের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সকলেই নিজেই চোখের জল ফেলেছে। 

এদিকে, বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে উল্লাপাড়া উপজেলার তেলীপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাযা শেষে তেলিপাড়া কবরস্থানে ৪ জনের এবং একই সময় বানিয়াকৈড় ও ফাজিলনগর কবরস্থানে বাকী দু'জনকে লাশ দাফন করা হয়। জানাযা নামাজে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিপুবর্গসহ বিল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। 

এর আগে পরিবারের মুখে আহার তুলে দিতে কাজ করতে গিয়ে বুধবার নারয়াণগঞ্জ আলীরটেক ইউনিয়নের গোগনগর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীতে ট্রলার ডুবিতে ঘুমন্ত অবস্থায় উল্লাপাড়া উপজেলার উধুনিয়া ইউনিয়নের গারেশ্বর গ্রামের মন্তাজ আলীর দুই ছেলে নেজাব আলী (৩৮) ও সুজাব আলী (৩২), শহিদুল ইসলামের ছেলে শরিফুল ইসলাম (১৮), আজিজল হকের ছেলে শাহীন (২৮), বানিয়াকৈড় গ্রামের সিদ্দিকের ছেলে সুজন (৩০) এবং ফাজিলনগর গ্রামের চয়েনদির ছেলে আবু তালেবের (৩০) মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। 

সরেজমিনে জানা যায়, নিহতের ৬ জনই হতদরিদ্র ও ভূমিহীন। প্রত্যেকেই পরিবারে নিহরা একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ছেলে-মেয়েদের নতুন পোশাক, লেখাপড়ার খরচ ও পরিবারের মুখে আহার তুলে দিতে নিজ ভূমি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিল মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে। কিন্তু একটি ঝড়ে তারা চিরনিন্দ্রায় চলে গেল।

গারেশ্বর গ্রামের মন্তাজ আলী দুই সন্তান নেজাব ও সুজাবকে হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু বুকফাটা আর্তনাদ করছেন আর বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন। নেজাবের স্ত্রী কদভানু একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে পাগল প্রায়। ছোট তিন ছেলে কবির (৭), করিম (৯), নবীর (৫) বার বার বাবার মুখের কাছে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। সুজাবের স্ত্রী আনজিরা খাতুন স্বামীর হারিয়ে পাগলের মতো বিলাপ করছেন আর মুর্ছা যাচ্ছেন। 

বাবা-মা, স্ত্রী রাশিদা খাতুন, ৫ বছরের মেয়ে মিম এবং ৩ বছরের ছেলে রাব্বীকে নিয়ে ছিল শাহিনের একটি ছোট সংসার। তার মৃত্যুতে শাহিনের পরিবারের নেমে এসছে কালো অন্ধকার। পাগল প্রায় স্ত্রী রাশিদা বিলাপ করে বলছেন, মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ফোনে কথা হয়েছিল। এ সময় ছেলে-মেয়ের জন্য কি কি কিনতে হবে তা শাহিন জানতে চেয়েছিল। কিন্তু আদরের সন্তানের জন্য কিছু আনা হলো। লাশ হয়ে ফিরলো শাহিন। 

একই গ্রামের শহিদের ছেলে শরীফুল ইসলাম ছিল পরিবারের একমাত্র সন্তান। মা সালেখা খাতুন ছেলের মৃত্যুতে বুক ফাটা আর্তনাদ করছেন আর শহিদ বাক স্তব্ধ হয়ে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। বৃদ্ধ দাদি চোখের জল ফেলছেন আর শেষ গোসলের জন্য বড়ই পাতার পানি গরম করছেন। ফাজিল নগর গ্রামের চয়েনদ্বির ছেলে তালেব ও পাশ্ববর্তী বাঙ্গালা ইউনিয়নের বানিয়াকৈর গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে সুজন (৩০) পরিবারেও চলছে শোকের মাতম।

গারেশ্বর গ্রামের নিহত শ্রমিকের কবর খনন কাজে নিয়োজিত জহির উদ্দিন (৬৫) ও আব্দুস সালাম (৪০) জানান, এর আগে কখনও এ অঞ্চলের কোন গ্রামেই একসঙ্গে ৬ ব্যক্তির মৃত্যেুর খবর তাদের জানা নেই। তারা শোককে বুকে চেপে কবরগুলো খনন করছেন। 

এদিকে, ট্রলারডুবিতে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
 
এ বিষয়ে উল্লাপাড়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) আকরাম আলী ও উধুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম এ হামিদ জানান, সকালে ৬টি লাশ এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের ত্রাণ ও পুনবার্সন তহবিল হতে প্রত্যেকের লাশ পরিবহন ও সৎকারের জন্য দেয়া ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। 

বিডি-প্রতিদিন/২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর