২৯ মে, ২০১৬ ১৩:২৫

মংলায় দু'সপ্তাহ ধরে পানির জন্য হাহাকার

শেখ আহ্সানুল করিম, বাগেরহাট :

মংলায় দু'সপ্তাহ ধরে পানির জন্য হাহাকার

দেশের দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর শহর মংলা পোর্ট পৌরসভায় পানির জন্য হাহাকার চলছে। এই শহরে পানির প্রধান উৎস পৌরসভার পানি শোধন ও সরবরাহ কেন্দ্রের পুকুরের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় গত দু’সপ্তাহ ধরে এখানে পানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া এখন পর্যন্ত বৃষ্টিও তেমন নেই। এ কারণে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পানির অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক পৌরবাসী। এতে করে অনেকে বাধ্য হয়ে চড়া দাম দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে পুকুরের লবণ মিশ্রিত দূষিত পাণি পান ও ব্যবহার করছেন। এ কারণে ইতিমধ্যে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই বিশেষ করে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কবে নাগাদ পানি সরবরাহ শুরু করা হবে তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌরবাসীর অভিযোগ, পানি শোধনাগার কেন্দ্রে মাছ চাষ, সঠিক সময়ে নদী থেকে পানি উত্তোলন না করা, অযোগ্য লোক দিয়ে শোধনাগার চালানোসহ নানা অনিয়মের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

মংলা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, লবণ পানি-অধ্যুষিত মংলাবাসীর সুপেয় পানির সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০০৫ সালে পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি উত্তোলন ও সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে পৌরসভার মাছমারা এলাকায় ৮৪ একর জায়গায় পাঁচ লাখ লিটার ধারণ ক্ষমতার একটি উচ্চ জলাধার, ৪৬ কোটি লিটার ধারণক্ষমতার একটি পানি শোধন ও সরবরাহ কেন্দ্রের কাজ শুরু করা হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে হন্তান্তর করে। ছয় বছর ধরে পৌর কর্তৃপক্ষ পৌর এলাকার ১ হাজার ৯০০ পরিবারকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক রেশনিং করে সকালে ও বিকেলে সুপেয় পানি সরবরাহ করে আসছিল। কিন্তু গত মাস থেকে পুকুরের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় শুধু সকালে একবার সামান্য পানি সরবরাহ করা হতো। ১৬ মে থেকে এ সরবরাহ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

মংলা বাজার মসজিদের ইমাম তৈয়বুর রহমান বলেন, ১৭ মে পৌর কর্তৃপক্ষ মাইকযোগে জানিয়ে দিয়েছেন, আপাতত আর পানি দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পানি ছাড়া তো এক দিনও চলা যায় না।

মংলা নাগরিক কমিটির সভাপতি শেখ নূর আলম বলেন, পৌর এলাকার পানি সরবরাহ বন্ধ থাকার চারদিকে পানির জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। চড়া দাম দিয়েও সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পৌরবাসীকে নানা বেগ পেতে হচ্ছে। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সরবরাহ বন্ধ থাকলেও পৌরবাসীর কাছ থেকে ঠিকই পানির বিল আদায় করা হচ্ছে।

পানি শোধনাগারের পাম্পচালক শাহীন বলেন, পুকুরের কিছু অংশের খননকাজ করায় পানি শুকিয়ে গেছে। তা ছাড়া নদীর পানি এখন অনেক লবণাক্ত। সেই পানি পুকুরে ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

এদিকে, পৌর এলাকায় পানি শোধন ও সরবরাহ কেন্দ্র চালু করার পর অধিকাংশ পৌরবাসী তাদের বাড়ির পুকুর বালি দিয়ে ভরাট করে ফেলেছেন। এতে করে অধিকাংশ আবাসিক এলাকায় পুকুর না থাকায় খাবার ও ব্যবহারের জন্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া মংলা এলাকার টিউবওয়েলেও নোনা পানি ওঠে। এসব কারণে বাধ্য হয়ে লোকজন চড়া দাম দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে পুকুরের দূষিত নোনা পানি সংগ্রহ করে তা ব্যবহার ও পান করছে। নাম মাত্র যে কয়টি পুকুর রয়েছে সেখানে নারী-পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে এক কলস করে পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু সেই পানিও শেষের দিকে। এদিকে বিশুদ্ধ খাবার পানি না পেয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে দূষিত লবণ পানি পান করছেন। এতে করে শিশুসহ অনেকই প্রচণ্ডে গরমে পেটের পীড়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কলসালটেন্ট (শিশু) ডা. তরুন কান্তি দাস জানান, প্রায় প্রতিদিরই শিশুসহ বিভিন্ন রোগী পানিবাহিত রোগে আকান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসে ভিড় জমাচ্ছেন।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী এস এম কায়েচ বলেন, ‘জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নদীর মিষ্টি পানি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুকুরে তোলা হয়। কিন্তু এবার পানি তোলার মৌসুমে পুকুরে পর্যাপ্ত পানি ওঠানো হয়নি। তাই এ সংকট দেখা দিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের এই শোধনাগার প্রকল্প যারা দেখভাল করছেন, তারা এ বিষয়ে কতটুকু যোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া পুকুরে মাছ চাষ করে সেই মাছ ধরতে গিয়েও কিছু পানি কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি আমি পৌর মেয়রকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের পক্ষ থেকে পানি শোধনের একটি গাড়িতে করে প্রতিদিন ৫০০ জনকে ১০ লিটার করে পানি সরবরাহ করছি। তবে চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম।’

শেহালাবুনিয়া এলাকার গৃহবধূ প্রতিমা রানী, মানসী বিশ্বাস ও ফাতেমা বেগম বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের গাড়ি থেকে পানি আনতে যে লাইনে দাঁড়াতে হয়, তা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তাই এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।’

মংলা পৌরসভার মেয়র জুলফিকার আলী বলেন, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নতুন একটি পুকুর ও পুরোনো পুকুরের খননকাজ একসঙ্গে শুরু করেছে। তাই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া নদীর পানি তোলার পাইপেও তারা কাজ করছেন। এ কারণে নদী থেকেও পানি তোলা যাচ্ছে না।

বিডি-প্রতিদিন/২৯ মে, ২০১৬/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর