৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১৮:০৫

বগুড়া স্টেশন রোডের বধ্যভূমিটি হারিয়ে যেতে বসেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

বগুড়া স্টেশন রোডের বধ্যভূমিটি হারিয়ে যেতে বসেছে

বগুড়া শহরের চকসূত্রাপুর থেকে এক দল মুক্তিকামী মানুষ ধরে নিয়ে এসে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় পাক বাহিনী। দুই পরিবারের ৫ জনসহ প্রায় ২০ জনকে গুলি করে ও বেয়োনেট চালিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখে বগুড়া শহরের রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশের সামনের অংশে। স্বাধীনতার পর স্থানটি গণকবর বা বধ্যভ’মি হিসেবে স্বাকৃতি পায়। কিন্তু সে স্বীকৃতি এখন মরিচা ধরেছে। গণকবরে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও যত্নের অভাবে ও স্থানীয়দের দৌরাত্ম্যে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। বধ্যভূমিটি রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দাবি জানিয়েছেন।

জানা যায়, বগুড়া শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকার গণকবর লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছে। দখলদারেরা গণকবরের প্রবেশের মুখ দখল করে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মান করেছে। দিনের বেলা টোকাই রা সেখানে আশ্রয় নিয়ে ময়লা আবর্জনায় শ্রীহীন করে ফেলেছে। ফলে মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে আত্মত্যাগকারীরের জন্য নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভ আড়াল থেকে আড়ালে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এ অবস্থায় থাকলেও  খোঁজ খবর নেওয়ার কেউ নেই। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বহিনী বগুড়া রেল স্টেশনের দক্ষিনে চকসুত্রাপুর এলাকার বহু মানুষকে ধরে আনে হানাদার বাহিনী। এর মধ্যে রাজাকারদের সাথে নিয়ে তারা রেল স্টেশনের উত্তরপাশে ফাঁকাস্থানে দুই পরিবারের ৫ জনসহ প্রায় ২০ জনকে গুলি করে ও বেয়োনেট চালিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখে। এদের মধ্যে রয়েছে আলহাজ্ব হানিফ উদ্দিনের তিন ছেলে তৎকালিন এজি অফিস ঢাকার অডিটর শহিদ আব্দুস সাত্তার শহিদ, মৌলানা আব্দুল কাদের এবং শহিদ আব্দুস সাত্তার। এছাড়াও সমবায় সমিতির অবসরপ্রাপ্ত জেল পরিদর্শক শহীদ আব্দুল গনি ও তার ছেলে আব্দুল মতিন সুজা। এছাড়াও এক জনের নাম জানা গেছে তিনি হলেন শহিদ মেহের আলী শেখ বাচ্চা। 

চকসূত্রাপুর এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাবেক পৌর কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান টুকু জানান, রেলওয়ের ওই গণকবরে অন্তত ২০ জন শহীদ রয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারের লোকজন নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনের লাশ শনাক্ত করেন। কিন্তু তারা লাশ নিয়ে যেতে পারেননি। সেখানেই কবর দেন। কোন কোন শহীদের লাশ নিয়ে যাওয়ার মতও ছিল না। বধ্যভূমিটি দীর্ঘদিন অরক্ষিত থাকার পর ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে শহরের এই গনকবরটি সংস্কার করে স্মৃতি স্তম্ব নির্মাণ করা হয়। স্মৃতি স্তম্ভকালীন সময়ে স্টেশন রোড থেকে স্মৃতি স্তম্ভপর্যন্ত ৩০ ফুট প্রসস্ত রাস্তা রাখা হয়েছিল যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে সেখানে যেতে পারেন। মাত্র কয়েক বছরে এই রাস্তা দখলে নিয়েছে অবৈধ দখলদারেরা। এনে ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করে দখল করা হয়েছে জায়গা। কেউ বা আবার গড়েছেন রিক্সা গ্যারেজ, ছিন্নমূল মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়ে ময়লা আবর্জনা করে শ্রী নস্ট করছে। রাতের আধারে মাদকসেবীদের আনাগোনা দেখা যায়। বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভবটি রক্ষার জন্য শহীদ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধারা দাবি জানিয়েছেন। 

বগুড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের সহকারি ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী জানান, বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর এলাকার বেশ কিছু মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে হত্যা করে পাক বাহিনী। পরে সেখানে মাটি চাপা দেওয়া হয়। বধ্যভূমিটি এখন একাত্তরের একটি স্মৃতি চিহ্ন বহন করছে। কিন্তু, সেটি আজ অবৈধ দখলদের কারণে মর্যাদা নস্ট হতে চলেছে। 

বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কোষাধ্যক্ষ ও চকসুত্রাপুরের বাসিন্দা জাহিদুর রহমান মুক্তা জানান, তার চাচাতো ভাই সুজা, তার প্রতিবেশি আব্দুর সাত্তার, গনি মিয়াকে ধরে নিয়ে গিয়ে বগুড়া রেলওয়ের ফাঁকা জায়গায় গুলি করে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায়। সেখানে শহীদদের মাটি চাপা দেওয়া হয়। দির্ঘদিন অরক্ষিত ছিল। পরে একটি স্মৃতি স্কম্ভ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেটি এখন ছিন্নমূলেরা দখল করে নিয়েছে। দিন যাচ্ছে আর শহীদদের স্মৃতি নস্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি উদ্ধার করে যত্ন নিলে শহীদদের স্মৃতি রক্ষা হবে। 

বগুড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন বাবলু জানান, দীর্ঘদিন ধরে অবেহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে গণকবরটি। তিনি জানান, বেশ কিছু দিন আগে এব্যপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ওই এলাকাটি ছিন্নমূল আর মাদকসেবি ও অবৈধদখলদারের কবলে রয়ে গেছে। এটি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে দাবি জানাচ্ছি। 

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬/ আফরোজ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর