৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১৭:৫৯

সবুজ পাহাড়ে একাত্তরের তীরন্দাজ স্মৃতিস্তম্ভ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট:

সবুজ পাহাড়ে একাত্তরের তীরন্দাজ স্মৃতিস্তম্ভ

হবিগঞ্জ জেলার বাহুবলের মধুপুর চা-বাগান। এরপাশেই পুটিজুরী বনবিট। এখানে চারদিকে পাহাড়ি টিলায় সবুজ ছায়াঘেঁরা। এর মধ্যে কারিগজিয়া ত্রিপুরা পল্লী। এ পল্লীতে শত শত বছর ধরে আদিবাসীরা বসবাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা কমানডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে এখানে গড়ে উঠে মুক্তি ক্যাম্প। যুদ্ধ চলাকালে প্রায়ই তিনি এখানে অবস্থান করে ক্যাম্পের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানা পরামর্শ দিতেন। 

এ ক্যাম্পের রাখা হত অস্ত্র। এখান থেকে অস্ত্রগুলো বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করা হতো। শুধু তাই নয়, আদিবাসীসহ স্থানীয়রা এ ক্যাম্প থেকে তীর ধনুক ও অস্ত্র নিয়ে কমানডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে পাক সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কমানডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা পায়ে হেঁটে শেরপুর-সাদীপুরে তীর ধনুক নিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কারণ আদিবাসীরা তীর ধনুকে পারদর্শী ছিলেন। এজন্য তারা তীর ধনুক নিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই করেন। এ লড়াইয়ে বিরাট সফলতা আসে। বিশেষ করে সে সময় এ ক্যাম্পটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয় আদিবাসী নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন।  

২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর কমানডেন্ট মানিক চৌধুরীর কন্যা কেয়া চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর কালিগজিয়ার ত্রিপুরা পল্লীতে পরিদর্শনে যান আদিবাসীদের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে। সে সময় স্থানীয় আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এমপি কেয়া চৌধুরী কথা বলে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে বরাদ্দ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে তিনি ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। বরাদ্দ সাপেক্ষে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এর সাথে মন্দিরের উন্নয়ন কাজের জন্যও এমপি কেয়া চৌধুরী বরাদ্দ দেন। তার বরাদ্দে পল্লীতে একটি ভ্যানগাড়ীও দেয়া হয়।

বিজয়ের এ মাসে ইসান দেববর্মায় আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বরণে এ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন এমপি কেয়া চৌধুরী। এ সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী পরিবারের নেতৃবৃন্দ, আদিবাসী পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় যুদ্ধে ব্যবহৃত তীর ধনুক, রান্নার পাতিল, কাপড়সহ নানা প্রাচীণ জিনিসপত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা এমপি কেয়া চৌধুরীর হাতে তুলে দেন। এগুলো হবিগঞ্জ শহরে নির্মাণতব্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমানডেন্ট মানিক চৌধুরী জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। 

এমপি কেয়া চৌধুরী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে এদেশ স্বাধীন করেছেন। শুধু তাই নয়, অসংখ্য মা বোনের ইজ্জত হারাতে হয়েছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়েই আমরা স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। তিনি বলেন, বর্তমান জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কাজ করছে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখতেই এখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এ স্তম্ভ দেখে নতুন প্রজন্মরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।

এদিকে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জীবিত রয়েছেন সঞ্জয় দেববর্মা, মহেন্দ্র দেববর্মা, সোনা মনি দেববর্মা, গোবিন্দ্র দেববর্মা, দেবেন্দ্র দেববর্মা, ব্রজেন্দ দেববর্মা, দীনেশ দেববর্মা, রাজপদ্ধ দেববর্মা,  ভদ্রমনি দেববর্মা, যতিন্দ্র দেববর্মা, বিনয় দেববর্মা এবং সচিন্দ্র দেববর্মা। মারা গেছেন ইন্দ্র মনি দেববর্মা, হরেন্দ্র দেববর্মা, বিধু দেববর্মা, গুণমনি দেবর্মা এবং গোপাল নদ্র দেববর্মা।  জীবিত থাকা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ জীবনের কাহিনী এমপি কেয়া চৌধুরীকে শুনিয়েছেন। 

আলাপকালে মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কমানডেন্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃতে আমরা পাক সেনাদের উপর তীর ধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এখান থেকে নানাস্থানে অস্ত্র সরবরাহ করেছি। একদিন দেশ স্বাধীন হল। আমরা পেলাম মুক্ত দেশ। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত  কমানডেন্ট মানিক চৌধুরী আমাদের খবর নিয়েছেন। এরপর কেউ আমাদের খবর নেয়নি। আমরা আর কতদিন বাঁচব। যাই হোক মৃত্যুর পূর্বে নিজ থেকে এমপি কেয়া চৌধুরী আামাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এটাই আমাদের বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখতে এমপি চৌধুরীর বরাদ্দে এ সবুজ পাহাড়ে লাল রঙ মাখা নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন হলো। কি যে আনন্দ লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। 


বিডি প্রতিদিন/৯ ডিসেম্বর ২০১৬/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর