১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ১৩:১৩

মাগুরায় লটারীর নামে চলছে জুয়া, নিশ্চুপ প্রশাসন

নিঃস্ব হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ

মাগুরা প্রতিনিধি:

মাগুরায় লটারীর নামে চলছে জুয়া, নিশ্চুপ প্রশাসন

মাগুরা পৌর এলাকার আবালপুর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ মাঠে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলার নামে চলছে ভয়ানক জুয়া খেলা। যার নাম দেয়া হয়েছে দৈনিক টু স্টার র‌্যাফেল ড্র। আর এ লটারীর টিকিট কিনে নিঃস্ব হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

 
প্রতিদিন ২০ টাকার টিকিটে হাফ ডজন মটরসাইকেল, স্বর্ণের চেইন, স্বর্ণের দুলসহ বিভিন্ন গৃহ সামগ্রী লটারী বিজয়ীদের জন্য উপহার হিসেবে দেয়া হচ্ছে। কোন কোন দিন থাকছে দুই লক্ষ টাকার নগদ অর্থের পুরষ্কার। মঙ্গলবার ৪টি মটর সাইকেলসহ পুরষ্কারের সংখ্যা ছিল ৭১টি। এদিকে টিকিট সংগ্রকারীদের বেশীর ভাগই রিকশা-ভ্যান চালক ও দিনমজুর শ্রেণীর হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে এটি ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

চলতি মাসের ৮ তারিখ থেকে মাসব্যাপী এ মেলা শুরু হয়। আবালপুর আইডিয়াল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের আর্থিক সহযোগিতার জন্য এ মেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। 

শহরের প্রধান সড়ক, গুরুত্বপূর্ণ মোড়সহ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিদিন ৩ শতাধিক ভ্যান ও ব্যাটারী চালিত বিভিন্ন যানবহন টিকিট বিক্রির কাজে ব্যাবহার করা হচ্ছে। প্রচার মাইককে লক্ষ করে হাজার হাজার মানুষ টিকিট কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। অনেকেই সারা দিনের উপার্জন দিয়ে টিকিট কিনে রাতে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন। 

জাগলা এলাকার গৃহবধূ জাহানারা বেগম জানান, তার ভ্যান চালক স্বামী আবু তালেব গত কয়েকদিনে তার উপার্জনের সব টাকাই টিকিট কেনার কাজে খরচ করেছে। যে কারণে তাদের দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারটি চরম অর্থ সংকটে পড়েছে। 

রাঘব দাইড় ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামের ছবেদা বেগম জানান, তার ছেলে ছরোয়ার হোসেন একই ভাবে তার দিন মুজুরীর সমস্ত টাকা টিকিট কেনায় খরচ করেছেন। এই গ্রামের হাবীবুর রহমান নামে এক ভ্যান চালক টিকিট কিনে মটরসাইকেল জেতায় গোটা এলাকার মানুষ এখন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে লটারীর টিকিট কেনার নেশায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার উপজেলার এমন কোন প্রত্যন্ত গ্রাম নেই যেখানে লটারীর টিকিট বিক্রির প্রচার মাইক ও গাড়ী পৌঁছেনি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শহরের অলিগলিসহ প্রত্যন্ত গ্রামে টিকিট বিক্রির ধুম পড়ে যায়। জেলার যুবকদের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার যুবকরা এই লটারীর টিকিট বিক্রির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

টিকিট বিক্রেতা মাদারীপুরের সুজন জানান, তাকে প্রতিদিন টিকিট বিক্রির জন্যে ৫০০ টাকা সম্মানী দেয়া হয়। বিভিন্ন এলাকার আরো কয়েকজন লটারী বিক্রেতার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। পুরষ্কার ও দৈনন্দিন খরচ ধরা হয় ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা। 

রাত ১০টার পর পরই মেলার র‌্যাফেল ড্র মঞ্চে একটি শিশুর চোখ বেধে একটি করে টিকিট তুলে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এছাড়া মোটরসাইকেল ও নগদ অর্থ বিজয়ীদেরকে টিকিটের অর্ধেকটাতে লেখা মোবাইল ফোন নম্বর অনুযায়ী কল করে গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে তুলে পুরষ্কারের কথা জানানো হয়। গোটা অনুষ্ঠানটি গত কয়েকদিন যাবত মাগুরা শহরের স্টার কেবল নেটওয়ার্ক নামের একটি কেবল অপারেটরের মাধ্যমে সরাসরি প্রচার করায় এটি আরো বেশি প্রভাব ফেলেছে। গভীর রাত পর্যন্ত কনকনে শীতে টিকিট ক্রেতারা মেলা স্থলে অপেক্ষমান থেকে র‌্যাফেল ড্র উপভোগ করছেন। 

টিকিটের কোন স্থানেই মেলাস্থলের ঠিকানা লেখা নেই। গোটা টিকিট দুইভাগে বিভক্ত। একটি অংশ গ্রাহকদের দেয়ার জন্যে। অপরটি র‌্যাফেল ড্রতে রাখার জন্য। র‌্যাফেল ড্র’র অংশটিতে ক্রেতার নাম ও মোবইল নম্বর দেয়া থাকেছে। যাতে পুরস্কার প্রাপ্তির সাথে সাথে ওই নম্বরে যোগাযোগ করে ফলাফল জানানো যায়। র‌্যাফেল ড্র মঞ্চে মাগুরা পৌরসভার স্থানীয় কাউন্সিলরসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রতি রাতেই দেখা যায়। যারা এই লটারীর নেপথ্য আয়োজক। 

এ বিষয়ে মাগুরা পৌরসভার ওই এলাকার কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম পলাশ বলেন, ‘আমার এলাকায় মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ কারণে আমি সেখানে থাকি। এছাড়া এখানে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই’।

মাগুরা পুলিশ সুপার মুনিবুর রহমান বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন অনুমোদন দেয়ার সুযোগ নেই। সাধারণত জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে এধরনের মেলা অনুষ্ঠিত হবার কথা’। 

মাগুরা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক আজমুল হক বলেন, ‘এধরনের মেলা কিংবা র‌্যাফেল ড্র এর অনুমোদন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। আমরা পৌর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি। র‌্যাফেল ড্র বন্ধ না হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এটি বন্ধ করে দেয়া হবে’।

এদিকে এ বিষয়ে মাগুরা পৌর মেয়র খুরশিদ হায়দার টুটুল বলেন, ‘মানুষের বিনোদনের জন্য মেলার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে কারো কোন ক্ষতি হচ্ছে না’।

আবালপুর বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ নাসিরুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘আমার জানা মতে পৌরসভা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুমতি নিয়েই এ মেলা বসেছে। মেলা উপলক্ষে আমাদের কলেজের উচু নিচু মাঠটি সমান করে দেয়া হয়েছে। এটাই আমাদের লাভ। এছাড়া বিকালে মেলা বসায় আমাদের ক্লাসের কোন ক্ষতি হচ্ছে না’।


বিডি প্রতিদিন/১৮ জানুয়ারি ২০১৭/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর