২০ জুলাই, ২০১৭ ১৭:৫৫

বরিশালে ৩ হাজার টাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চ তৈরী করল যুবক!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল

বরিশালে ৩ হাজার টাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চ তৈরী করল যুবক!

বরিশাল-ঢাকা রুটের বিলাসবহুল তিনতলা একটি লঞ্চ নির্মান করতে খরচ হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকা। পন্যবাহী একটি জাহাজ নির্মানেও খরচ হয় ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা। একটি ১০তলা ভবন নির্মানেও খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। সেখানে মাত্র আড়াই হাজার টাকায় ১০ তলা সুরম্য ভবন এবং ৩ হাজার টাকায় চারতলা একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ পাওয়া যাচ্ছে বরিশালে। কল্পনা নয়, সত্যি সত্যিই বরিশালে স্বল্প খরচে নির্মিত হচ্ছে ১০তলা ভবন, যাত্রী ও পন্যবাহী জাহাজ, নৌকা সহ যে কোন নৌযান, বসতঘর, মসজিদ সহ প্রায় নানা ধরনের অবকাঠামো। 

তবে এগুলো আসল বসতবাড়ি কিংবা নৌ-পথে চলাচলের মতো উপযোগী কোন নৌযান নয়, বাস্তবকে অনুকরন করে কোন ধরনের কারিগরি শিক্ষা ছাড়াই অসিম ধৈর্য্যরে সাথে শুধুমাত্র বাঁশ দিয়ে দৃস্টিনন্দন এসব শো-পিস তৈরী করছেন বরিশাল নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের হরিনাফুলিয়া জাঙ্গাল সড়ক সরদার বাড়ির কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রহিম সরদারের ছেলে স্বল্প শিক্ষিত যুবক বেল্লাল সরদার। উৎপাদিত শোপিচ বিক্রির জন্য বরিশাল নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের নবগ্রাম রোড সোনামিয়ার পোল সংলগ্ন (সোনা মিয়া বাড়ির পাশে) রফিক মার্কেটে শো-রুম (বিক্রয় কেন্দ্র) করেছেন তিনি। 

সৌখিন মানুষজন বেল্লালের নিপুন হাতের ছোয়ায় তৈরী শোপিচগুলোর নান্দনিকতা দেখে মুগ্ধ হন এবং কিনে নেন। বাঁশ দিয়ে তৈরী এসব নিপুন শোপিচ যেকোন উৎসবে উপহার দেয়া সহ ঘরে সাঁজানোর জন্য কিনে নিচ্ছেন ক্রেতারা। দামও ক্রেতার নাগালে। এখন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোপিচ তৈরীর কারখানা করে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃস্টি সহ দেশ-বিদেশে তার সৌখিন কারুকাজের শো-পিস গুলো রপ্তানী করা সম্ভব বলে মনে করেন বিস্ময় যুবক বেল্লাল। 

কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রহিম সরদারের তিন ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় বেল্লাল সরদার দ্বিতীয়। অভাব-অনটনের সংসারে বড় ভাইয়ের লেখাপড়া হয়নি। নিজের এবং পরিবারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বেল্লালের পড়ালেখা হয়নি। এসএসসি পরীক্ষার আগে ২০০৮ সালে পড়ালেখা ছেড়ে পরিবারের ঘানি টানতে কর্মজীবনে নামতে হয়েছে তাকে। পড়ালেখা ছেড়ে বড় ভাই ইলেক্ট্রিশিয়ান দুলাল সরদারের কাছ থেকে রপ্ত করেন ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ। 

ইলেক্ট্রিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক বছর আগে প্রথমে শখেরবশত একটি কবুতরের খাঁচা তৈরী করেন তিনি। ৫দিন বসে কবুতরের খাঁচা তৈরী করতে ৫শ’ টাকা খরচ হয় তার। সফলভাবে খাঁচা তৈরীর পর তিনি দিয়াশলাইয়ের কাঠী এবং বাঁশের বেতি (চোরাই করা অংশ) দিয়ে ছোট একটি দোচালা কাঠ-টিনের ঘরের আকৃতি তৈরী করেন তিনি। এরপর কৌতুহলবশত শুধুমাত্র বাঁশের বেতি এবং সুপারগাম দিয়ে একটি ৪তলা বিশিস্ট পাকা ভবনের আকৃতি তৈরী করেন বেলাল। এরপর নিজের আগ্রহে তৈরী করেন একটি ৪তলা যাত্রীবাহি লঞ্চের আকৃতি। 

তৈরী পন্যগুলোর নান্দনিকতা দেখে মানুষের প্রসংশায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। এতে বেড়ে যায় তার আত্মবিশ্বাস। এরপর একে একে তৈরী করেন পাশের বেতি দিয়ে দোতালা পাকা বাড়ি, শুধু দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ডুপ্লেক্স পাকা বাড়ি, ১০তলা পাকা ভবন, বাগেরহাটের ৯ গম্ভুজ মসজিদ (ষাট গম্ভুজ মসজিদ নয়), শহীদ মিনার, চারচালা দোতালা কাঠের ঘর, নৌকার আকৃতি সহ ১০ ধরনের শতাধিক পন্য। বাঁশ দিয়ে বেল্লালের হাতে তৈরী লঞ্চে রয়েছে সিঙ্গেল ও ডবল কেবিন, সোফা সেট, বাথরুম-টয়লেট, লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষ, চালকের নির্দিষ্ট স্থান (মাস্টার ব্রীজ) এবং ডেক। 

একইভাবে পাকা বাড়ির আকৃতির মধ্যে প্রবেশ পথ, উপরে ওঠার সিঁড়ি, নিচতলায় গাড়ি পার্কিং, প্রতিটি তলায় আলাদা কক্ষ, দরজা-জানালা ও বাথরুম। এছাবে প্রতিটি শোপিচ প্রকৃত ভবন বা স্থাপনার আদলে তৈরী করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুন কারুকাজের বিষয়টি। স্বচোক্ষে যে স্থাপনা দেখলে কিংবা কোনো অফিস-আদালত, ভবন-বসতঘর, লঞ্চ-জাহাজ-নৌকা, উড়োজাহাজ ইত্যাদি দেখালে বাঁশ দিয়ে অবিকল সেগুলো বানাতে পারেন তিনি। বাঁশের বেতি (চেরাই অংশ), কখনো দিয়াশলাইয়ের কাঠী ছাড়াও বেল্লাল তার নান্দনিক কারুকাজে ব্যবহার করেন দা, করাত, হাতুরী, বাটাই (বাটালী) ও সুপার গাম। কোন কোন পন্যের আসল চিত্র ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রং। 

৪তলা একটি লঞ্চ তৈরী করতে তার সময় লেগেছে ২২দিন এবং ঘর তৈরীতে সর্বনিন্ম সময় লেগেছিল ৫দিন। কাঠের ঘর বানাতে মজুরী ছাড়া ৮শ’, লঞ্চ বানাতে মজুরী ছাড়া সাড়ে ৩ হাজার, ১০তলা ভবন তৈরীতে মজুরী ছাড়া তার খরচ হয়েছিলো ২ হাজার ৬শ’ টাকা। 
 
বেল্লাল বলেন, আমার শ্রমের টাকা যদি ধরি, তাহলে এই পন্যগুলোর দাম হবে অনেক। এতে ক্রেতারা বিমুখ হতে পারেন। তাই আমার উৎপাদন খরচের সাথে সামান্য কিছু টাকা পেলেই ‘গ্রাম্য কাঠের ঘর সর্বনিম্ন ৯শ’ থেকে ১৮০০ টাকা, ৪তলা লঞ্চ ৬ হাজার টাকা, ১০তলা ভবন সাড়ে ৪ হাজার টাকা, শহীদ মিনার ১ হাজার টাকা, নৌকা ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকায় বিক্রি’ করছেন। 

আর্থিকভাবে দুর্বল অদম্য যুবক বেল্লাল সরদার বলেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে বেকার যুবকদের নিয়ে বানিজ্যিকভাবে ব্যাপক পরিসরে বাঁশ দিয়ে এই শোপিচ উৎপাদন করা সম্ভব। এগুলো দেশ-বিদেশে রপ্তানী করতে পারলে দেশের সুনাম বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে বহু বেকার মানুষের। এ লক্ষ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারের নীতিনির্ধারকের সু-দৃস্টি কামনা করেন। 

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২০ জুলাই, ২০১৭/ আব্দুল্লাহ সিফাত-৩

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর