মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মহিষমারী গ্রামের দিনমজুর বিজ্ঞান সরকার। সংসারের সমৃদ্ধির আশায় পারি জমিয়েছিল বিদেশ। একই উপজেলার জাহিদুল ইসলাম সহায় সম্বল বিক্রি করে সুখের আশায় সেই টাকা তুলে দিয়েছিল দালালের হাতে। দালালরা তাদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায় লিবিয়ায়। সেখানে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। 

নির্যাতনের সেই চিত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখানো হতো তাদের স্বজনদের। দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা দিতে না পারলে চালানো হতো আরো বেশি নির্যাতন। এভাবেই একটি চক্র বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতো। এই চক্রের হাতে জিম্মি রয়েছে মাদারীপুরের ২৮ জন। এমনই এক আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যকে আটক করেছে মাদারীপুর র‌্যাব। 

চক্রটি বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে যুবকদের লিবিয়ায় পাচার করে থাকে। পরে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যরা লিবিয়ার বন্দিশালায় তাদেরকে আটক রেখে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং বন্দীদের নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করে। এই চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ আগস্ট শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের ধুয়াটি গ্রাম থেকে সিরাজ মাতুব্বরকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি প্রাথমিকভাবে মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত বলে স্বীকার করেছে। এসময় তার নিকট থেকে মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত টাকা ব্যাংকে জমার রশিদ, ষ্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিনামাসহ বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণও উদ্ধার করে র‌্যাব। 

মেজর রাকিব আরও জানান, আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি লিবিয়া অংশের অন্যতম প্রধান জনাব মো. শহিদুল মাতুব্বর। এই চক্রটি লিবিয়া প্রবাসী মো. শহিদুল মাতুব্বর এর নেতৃত্বে লিবিয়ার বন্দীশালায় পাচারকৃত বাংলাদেশী যুবকদেরকে অর্ধাহারে-অনাহারে রেখে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং সিরাজ মাতুব্বরসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত সদস্যগণ পাচারের শিকার যুবকদের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে। 

তিনি আরো বলেন, গত ৬ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে ২৮ যুবককে পাচারের করে। এদের মধ্যে বর্তমানে ৮ জন  শহিদুল মাতুব্বরের অধীনে লিবিয়ার বন্দীশালায় জিম্মি আছেন। এই ৮ জনকে লিবিয়া প্রেরণের সময় পাচার চক্রটি প্রায় পয়ত্রিশ লক্ষ টাকা এবং লিবিয়ায় প্রেরণের পর মুক্তিপণ বাবদ আসামি সিরাজ মাতুব্বর বিভিন্ন সময় প্রায় বিশ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। ধারনা করা হচ্ছে আরো অনেক বেশি মুক্তিপণ আদায় করেছে এই চক্রটি।

বিদেশে পাচারের শিকার লিটু মন্ডলের মা ফনিমালা মন্ডল জানান, আমার ছেলে মিস্ত্রীর কাজ করতো। সংসারে অভাব ছিলো। সুখের আশায় দালালের কাছে ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠাই। তাকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হতো। এরপরে মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই নির্যাতনের চিত্র দেখানো হয়। দাবি করা হয় মুক্তিপণ। টাকা না দিলে নির্যাতনের মাত্র বাড়িয়ে দেয়া হতো। এভাবে প্রায় ১১ লক্ষ টাকা দিয়েছি দালাল চক্রের কাছে। এরপরও আরো টাকার জন্য আমার ছেলেকে জিম্মি করে রেখেছে। আমি সরকারের কাছে ওদের উদ্ধারের সহযোগিতা চাই। 

মানব পাচারের শিকার বিজ্ঞান সরকারের মা রেবা সরকার বলেন, আমরা গরীব মানুষ, সংসারে সুখের আশায় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। ভাবছিলাম বিদেশ থেকে অনেক টাকা পাঠাবে। আমাদের সংসারের দুঃখ ঘুচে যাবে। কিন্তু উল্টো এখন জমি জমা বিক্রি করে এবং সুদের উপর টাকা এনে দালালদের দিতে হচ্ছে। আরেক পাচারের শিকার পিন্টু মালোর ছোট ভাই ঝন্টু মালো বলেন, আমার ভাইয়ের মত আরো অনেকেই লিবিয়ার বন্দিশালায় জিম্মি রয়েছে তাদের সবাইকে মুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।

মাদারীপুর র‌্যাব-৮এর কমান্ডার রাকিব জানান, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ মোতাবেক র‌্যাব কর্তৃক মামলা দায়ের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে পাচার চক্রটির অন্যান্য সদস্যদেরও গ্রেফতার প্রক্রিয়া রয়েছে। তদন্তের স্বার্থে অনেকের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।

বিডি প্রতিদিন/২২ আগস্ট ২০১৭/হিমেল