১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ১১:৩২

বিরল রোগে দিশেহারা পরিবার, বিনা চিকিৎসায় একজনের মৃত্যু

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর:

বিরল রোগে দিশেহারা পরিবার, বিনা চিকিৎসায় একজনের মৃত্যু

চোখের সামনেই নাড়িছেড়া ধনদের মৃত্যু মুখী যাত্রা দেখেও দারিদ্রতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে অসহায় মা বাবা। পৈত্রিক সুূত্রে পাওয়া সামান্য জমিজমা সর্বস্ব বিক্রি করেছে একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে। কিন্তু বিধাতা যেখানে নীরব সেখানে যৎসামান্য সেই চেষ্টা কোন কাজে তো লাগেইনি বরং ধীরে ধীরে মেনে নিতে হচ্ছে প্রিয় সন্তানদের মৃত্যু পথযাত্রা। এমনই এক নির্মম বাস্তবতার মুখে বিরল রোগে আক্রান্ত জেলার রাজৈরের রাজ্জাক শেখের পরিবার। 

বিরল রোগে আক্রান্ত একমাত্র ছেলে আব্বাসের একটি পা অস্বাভাবিক আকার ধারন করে হাতির পায়ের সমান হয়েছে। এছাড়া শরীরজুড়ে হয়েছে আচিলের পাহাড়। ২৪ বছর ধরে বড় মেয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। আর বোন ৪০ বছরের প্রতিবন্ধী জীবন কাটাচ্ছে জরাজীর্ন বিছানাতে।  

সরেজমিন পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলার রাজৈর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের আলমদস্তার গ্রামের রং মিস্ত্রী আ. রাজ্জাক শেখের ৩ সন্তান ও বোন জন্ম প্রতিবন্ধী। ৪০ বছর বয়সী বোন ইসমত আরা শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী। বিছানাতেই যার জীবনযাপন। ২৪ বছর বয়সী বড় মেয়ে শারমীন আক্তারের একই দশা। সেও বিছানাতেই শুয়ে কাটাচ্ছেন দুর্বিসহ জীবন। ১৭ বছর বয়সী ছোট মেয়ে আদুরী আক্তার প্রতিবন্ধী জীবন কাটিয়ে একপ্রকার বিনা চিকিৎসাতেই মারা যায় ৩ বছর আগে। 

১৩ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে আব্বাস শেখ জন্মের পর ডান পা মোটা ছাড়া প্রায় স্বাভাবিকই ছিল। বংশের প্রদীপ নিভে যাওয়ার শংকায় মোটা পায়ের চিকিৎসা করাতে শুরু থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করে মা বাবা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামী দামী সকল হাসপাতালেই দৌঁড়াদৌঁড়ি করেন। কিন্তু বিধাতা যেখানে মুখ ঘুরিয়ে থাকেন সেখানে অসহায় পরিবারটিই বা কতটা সামাল দিতে পারে। দিনদিন অবনতির কারণে ছেলেটি ৩য় শ্রেনী পর্যন্ত পড়েও আর স্কুলে যেতে পারছে না। ডান পা টি ফুলে হাতির পায়ের সমান হয়ে গেছে। নির্গত হচ্ছে একধরনের রস। ছেলেটির সারা শরীর জুড়েই হয়েছে ছোট বড় হাজারো আচিল সদৃশ। বয়সের চেয়ে শারীরিক গঠন হয়ে রয়েছে ছোট।  চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা সবই গেছে। আছে শুধু বাড়িটুকু। তাই পরিবারটির প্রিয় সন্তানসহ সদস্যদের মৃত্যু পথযাত্রা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই পরিবারটির।

তাদের অসহায়ত্বের চিত্র তুলে ধরে পরিবারটির অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলাকাবাসি ও স্বজনরা। 

স্থানীয় হালিমা শেখ বলেন, এই পরিবারের তিন ভাই-বোন ও এক ফুফু শারিরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়। এক বোন চিকিৎসার অভাবে অনেক আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাসের যে কি রোগ হয়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। ওর চিকিৎসার জন্য ওর বাবা অনেক টাকা খরচ করতে গিয়ে জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব।

বিরল রোগে আক্রান্ত আব্বাসের বাবা রাজ্জাক শেখ বলেন, আমার দুই মেয়ে জন্ম থেকেই হাঁটতে পারে না। এক বোনেরও একই অবস্থা। বিছানায় রেখেই ওদের লালন পালন করেছি। তার মধ্যে ছোট মেয়েটি চিকিৎসার অভাবে প্রায় তিন বছর আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাস জন্মের সময় ডান পা তুলনামুলক মোটা ছিল। কিন্তু দিন দিন আব্বাসের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পা ফুলে হাতির পায়ের মত মোটা হয়ে গেছে। সারা শরীরে ঘায়ের মত হচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কোন পরিবর্তন হয় নাই। জমিজমা সব গেছে। এখন পরিবারের সবার খাবার জোটানোই আমার পক্ষে কষ্ঠ হচ্ছে, চিকিৎসা করাবো কিভাবে?

আব্বাসের মা আল্পনা বেগম বলেন, ঘরে তিনটি মানুষ মরণ ব্যধিতে আক্রান্ত। আমার স্বামী রং মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। ওদের চিকিৎসার জন্য জমিজমা বিক্রি করছি, অনেক টাকা ধারকর্জ করছি। এহন এই বাড়িটুকুই আছে। আমরা এহন কি করুম জানি না। সরকার যদি আমাগো সাহায্য করতে তাইলে আমাগো একমাত্র ছেলে আব্বাস মনে হয় সুস্থ হইয়া যাইতো। 

বিরল রোগে আক্রান্ত আব্বাস শেখ বলেন, আমার পা দিন দিন ফুলে মোটা হচ্ছে আর সারা শরীরে গোটা গোটা হচ্ছে। আবার পা থেকে দুর্গন্ধযুক্ত রস বের হচ্ছে। তাই স্কুলেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার অনেক ইচ্ছা হয় লেখা-পড়া করার। অন্য সবার মত খেলা-ধুলা করার। লেখা-পড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের জন্য কিছু করার অনেক ইচ্ছা হয় আমার। কিন্তু আমার দিন দিন যে অবস্থা হচ্ছে জানি না আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করবে কিনা। আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছা করে। আমি সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।

রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার মন্ডল বলেন, আব্বাস নামের কিশোরটি যে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে এটাকে আসলে এ্যালিফেন্ট ডিজিজ রোগ বলা হয়। তার পা দেখতে অনেকটা হাতির পায়ের মত। এই রোগটি যদিও জটিল কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বড় হাসপাতালে বিশেষ ধরনের অপারেশন ও ঔষুধের মাধ্যমে এর চিকিৎসা সম্ভব। আমি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে আব্বাস ও ওদের পরিবারের আরো দুই জনের শারিরিক অবস্থা দেখাবো। কর্তৃপক্ষের সাথে ওদের চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলবো।

রাজৈর পৌরসভার মেয়র শামীম নেওয়াজ মুন্সী বলেন, আব্বাস শেখের পরিবারটি খুবই অসহায়। ওদের তিন জনকে পৌরসভার পক্ষ্য থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। তবে আব্বাসসহ ওদের তিন জনের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। সরকারীভাবে ওদের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে ওরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।


বিডি প্রতিদিন/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর