২৪ জুন, ২০১৮ ১৫:৫৮

ভালুকায় বেড়েই চলছে শিশুশ্রম

মো. আসাদুজ্জামান সুমন, ভালুকা:

ভালুকায় বেড়েই চলছে শিশুশ্রম

 “একটা সিঙ্গেলেও ফুল গাড়ি যাত্রি পাইলাম না, কেমনে কি করাম কিচ্ছু বুঝতাছিনা, রোদের লাইগা মানুষ ঘরেত্তেই বাইর অইবার পারেনা। যাত্রীর কাছে ২টা টেহা বেশি চাইলে তারা দেয় ঝারি। আমরা গরীব মানুষ আঙ্গরে ২/৫টা টেহা বেশি দিলে কি এরুম কম পরে বুঝিনা’।

কথাগুলো বলছিলো ত্রিশাল টু ভালুকা লেগুনার হেলপার মো. মুজিব সবাই তাকে বাবু বলে ডাকে। সঠিক বয়সটা তার মা জানে আনুমানিক বয়স ৯/১০ বছর তো হবেই। তার প্রতিবেশি বন্ধু ইমন ও সাদ্দাম তৃতীয় শ্রেণীতে পরে বাড়ি পার্শ্ববর্তী বগা স্কুলে। তারাও ছাত্র বেশি ভালো না স্কুলে একদিন গেলে ৩দিন যায়না। মুজিবের সৌভাগ্য হয়নি স্কুলে যাওয়ার একটু বুঝমান হওয়ার পর থেকেই লেগুনাতে উঠে পরে সে। লেগুনাতে তার হেলপারির বয়স ২ বছর। উপজেলার ভরাডোবা ইউনিয়নের বাঘশাতরা এলাকার অসুস্থ ভ্যান চালক জাবেদ আলীর ৩য় সন্তান মুজিব। বড় ২ভাই গার্মেন্টসে চাকুরি করে। মুজিবের গার্মেন্ট ভালো লাগেনা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়নি শিক্ষাজীবনে হাফিজিয়া মাদরাসায় গিয়েছিলো কয়েকদিন সিফারা পড়া অবস্থায় মাদরাসা ত্যাগ করে, পরে কর্মজীবন হিসেবে লেগুনার হেলপারিকে বেছে নেয়। ইনকাম ভালো হলে ২শত টাকা পায় সে। আর বাজার খারাপ থাকলে কোনদিন ৫০ কোনদিন একশো আবার কোনো কোনো দিন শুধু পেটে ভাতেও কাজ করতে হয় তাঁকে। 

এখন মোফাজ্জল নামের এক ড্রাইভারের সাথে কাজ করে। তার উস্তাদ জানে মুজিব প্রতি সিঙ্গেলে ১০ থেকে ২০টাকা চুরি করে। এটা শুধু সে একা নয় এ লাইনের সবাই করে। সেই চুরির টাকা কখনও মুজিব বাড়িতে নেয়না নগদই কিছু একটা কিনে খেয়ে ফেলে। এই টাকা ভালো না তাই যেভাবে আসছে সেভাবেই যাবে। তাঁর স্বপ্ন ড্রাইভারী শিখে নিজে একটা লেগুনা কিনবে। তখন সব অভাব অনটন কেটে যাবে তাদের সংসারের। কিন্তু যে কাজ সে করছে, বয়স ও শারীরিক সামর্থে যেমন সে যোগ্য নয়, তেমনি শিশুশ্রম আইন অনুসারেও বেআইনি, এসবের কিচ্ছু জানেনা মুজিব। “স্বাধীন দেশে কাম করাম ভাত খাইয়াম। খারাপ কাজতো কিছু করতাছিনা। আমরা গবির মানুষ লেগুনাতে রৌদের মইধ্যে মানুষ ডাইক্কা আবার গাড়ির পিছনে দাঁড়াইয়া থাকাটা কিন্তু খুব শখের কাম না, আমারও ইচ্ছা করে আমার বন্ধু ইমন ও সাদ্দামের মত ইস্কুলে যাইবার, কিন্তু তহন আমার খরচ দিবো কেডা? আমার সংসার চালাইবো কেডা?” কথাগুলো খুব দাড়াজ কণ্ঠে বলছিলো মুজিব। 

শিল্পসমৃদ্ধ ভালুকায় শিশুশ্রম শুধু সড়কেই নয়, হোটেল, রেস্তোরা, গার্মেন্টস, শিল্প প্রতিষ্ঠান, দোকান, ভারী কারখানাতেও দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছেই। এসব যেন দেখার কেউ নেই। 

শিশুশ্রম বেআইনি জানা লেগুনা ড্রাইভার মোফাজ্জল আক্ষেপ করে বলেন, “কি করার আছে বাসস্ট্যান্ডের সব হেলপারের বয়স এমনই, এরা গরিব ঘরের সন্তান, পেটের দায়ে এ বয়সেই কামে নামছে, আইন তো ভাই কতই আছে কিন্তু অনেক জায়াগায় আইন চলেনা”। বাসস্ট্যান্ডে সব পুলাপাইনের লেখাপড়া, খাওন দাউন কাপড় চোপরের দায়িত্ব আমনেরা নেইন, কাল থাইক্কা একটা কম বয়সের পুলাপানও রাখতাম না আমরা, আমগর কাছে কম বয়সের কোন পোলাপান কামের লাইগা আইলে আপনেগর কাছে পাঠাইয়া দেম”।

পড়াশোনা না করেও ছোটবেলা থেকে কাজ করে কিভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়?- প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ড্রাইভার বলেন, ‘ইস্কুলের সার্টিফিকেট পাওয়া কোনো ঘটনা না। এইডা মাল দিলেই পাওয়া যায়। এগর সময় অইলে আমরাই ম্যানেজ কইরা দেম। আমারে যেরুম আমার ওস্তাদে দিছে’। তাছাড়া ভালুকায় ড্রাইভারি করলে লাইসেন্স লাগেনা”।

ভালুকা টু মাস্টারবাড়ি ও মাওনা, ভালুকা টু ত্রিশাল ও ময়মনসিংহ এসব রুটের লেগুনা ও অন্য পরিবহনগুলোর প্রায় সব হেলপারই শিশু। লেগুনা হেলপাররা একেবারেই ছোট হলেও ড্রাইভাররা কিছুটা বড়, তাও গড়ে ১৫/১৬ বছর। কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করায় তারা শিশু হলেও গাড়ি চালাচ্ছে এবং সম্পূর্ণ গাড়ির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বেও রয়েছে। 

১৬বছর বয়সী লেগুনার ড্রাইভার শামিম বলেন, ‘আগে লোকাল বাসের হেলপার আছিলাম। অহন ভালুকা টু মাস্টারবাড়ি রোডে লেগুনা চালাই। বয়সটা আরেকটু বাড়লেই একটা সার্টিফিকেট ম্যানেজ কইরা ড্রাইভিং লাইসেন্সটা লইয়া লইয়াম’’। 

ভালুকা হোটেল স্বাদ ইউনিট ২ এ হোটেল বয়ের কাজ করে করছে ১২ বছরের শিশু রিয়াজ মিয়া। তার হোটেলে কাজ করার বয়স ৩বছর। রিয়াজের বয়স যখন ৩ তখন তার বাবা ফয়জুদ্দিন শেখ টাঙাইলের এক মেয়েকে বিয়ে করে তাকে সহ তার মা ও বড় দুই ভাইকে বাড়িতে ফেলে চলে যায়। বাবা চলে যাওয়ার কিছুদিন পর গর্ভধারিনী মাও ত্রিশালে এক বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করে তাদের তিন ভাইকে ফেলে চলে যায়। বড় দুই ভাই কোলে পিঠে করে একটু বড় করে রিয়াজকে। স্কুলেও যায় সে, তখন তার স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কিছুদিন পর বড় ভাইয়েরা পড়াশুনা করাতে অসম্মতি জানায়। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রিয়াজ বড় ভাইদের ম্যানেজ করে দেওয়া হোটেল বয়ের কাজ নেয়। রিয়াজ বলেন, ‘আমার ২ ভাই আমারে পাইল্লা বড় করেছে। অহন আমি কাম করতে পারি বড় ভাইদের বোঝা হয়ে থাইক্কা লাভ কি? আমার পড়তে ভালো লাগে। আমি পত্রিকা পড়তে পারি। সুযোগ পাইলে আমি পড়বো’- আক্ষেপ রিয়াজের। আবার এসব শিশুশ্রমিক ও পথশিশুরা নেশাসহ বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। ভালুকা উপজেলা নির্বাহী আফিসার মাসুদ কামাল বলেন, সরকার শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার। তবে এসব বিষয়ে পরিবারের সহোগীতার জন্য কিছু করা যায়না। তবে যদি কোন পরিবার সন্তানের খরচ চালাতে অক্ষম হয় এবং প্রশাসনকে নিশ্চিত করে যে, তাদের সন্তানকে পড়াশুনা করাবেন তাহলে আমরা চেষ্টা করবো ওই শিশুর পরিবারকে সহযোগীতা করার।

বিডি-প্রতিদিন/ ই-জাহান

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর