২১ অক্টোবর, ২০১৮ ১৫:৫৮

মোংলায় ফাদার রিগন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

মোংলায় ফাদার রিগন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত

হাজারো ভক্ত-অনুরাগীদের কাঁদিয়ে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইতালির নাগরিক ফাদার মারিনো রিগনকে তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী রবিবার বিকালে বাগেরহাটের মোংলার শেলাবুনিয়ায় সেন্ট পল্স গীর্জার পাশে সমাহিত করা হয়েছে। ফাদার রিগনের মৃত্যুর এক বছর পর সরকারিভাবে তার মরদেহ ইতালি থেকে ভোরে দেশে আনা হয়। 

এরপর সকাল ৯টা ৪৮ মিনিটে তার কফিনবাহী হেলিকপ্টারটি মোংলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে অবতরণের পর ফাদার রিগনের কফিনটি গ্রহণ করেন খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস। মোংলা উপজেলা পরিষদের মাঠে ফাদার মারিনো রিগনের কফিনে সর্বস্তরের হাজার-হাজার মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সেখানে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। দুপুরে ফাদার মারিনো রিগনের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয় এবং সেন্ট পল্স হাসপাতালে মরদেহ নেয়া হলে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীসহ হাজারো অনুরাগীরা কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। 

রবিবার বিকালে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেন্ট পল্স গীর্জার পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফাদার মারিনো রিগনকে সমাধিস্থ করার সময়ে তার কফিনের সাথে ঢাকা থেকে মোংলায় আসা ইটালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, ইটালিতে বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল বীরপ্রতিক সাজ্জাত আলী জহির, সচিব নমিতা হালদার, খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ দুইয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সুডানা ইকরাম চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চীফ প্রোটকল অফিসার মোনতাসির, ঢাকার ফার্মগেট চার্চের ফাদার মাই লিলিয়ান, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব জহিরুল ইসলাম, উপ সচিব আসাদুল ইসলাম, বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার সুলাইমান হোসেন, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস ও পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়সহ কয়েক হাজার ভক্ত-অনুরাগী উপস্থিত ছিলেন।

ফাদার মারিনো রিগন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা প্রদানের পাশাপশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে সরকার তাকে Friends of Liberation War Honour পদক প্রদান ও বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয়।

ফাদার রিগন মোংলায় থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেললে ২০১৪ সালো ৭ ফেব্রুয়ারি তার ভাই-বোন এসে তাকে ইতালিতে নিয়ে যান। ইতালিতে মৃত্যু হলে তার লাশ বাগেরহাটের মোংলার সেন্ট পল্স গীর্জার পাশে সমাহিত করতে হবে এই শর্তে তিনি স্বজনদের সাথে ইটালি যেতে রাজী হন। গত বছরের ২০ অক্টোবর ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধৃ ফাদার রিগন। 

ইতালির নাগরিক ফাদার রিগন ১৯২৫ সারের ৫ ফেব্রুয়ারি সেদেশের ভিচেঞ্চায় জন্মগ্রহন করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে খৃষ্ট্রধর্ম প্রচারে ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় ছিলেন। সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাসহ অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা প্রদানের পাশাপশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেশ স্বাধীনের পর তিনি মোংলার শেলাবুনিয়ায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। 

দীর্ঘ সময়ে বাগেরহাটের মোংলায় অবস্থানকালে ফাদার মারিনো রিগন জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সেন্টপল্স উচ্চ বিদ্যালয়সহ ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেন্টপল্স হাসপাতালসহ প্রতিষ্ঠা করেন। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্ট পল্স সেলাই কেন্দ্র। যেখান থেকে নারীদের হাতে সেলাই করা নক্সীকাঁথা এখন বিদেশে রফতানি করা হয়। 

বাগেরহাটের আমজনতার হৃদয় জয় করে নেয়া ফাদার মারিনো রিগন একই সাথে মোংলায় বসে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের তিনশত পঞ্চাশটি গান, জসীম উদ্দীনের নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এদেশের খ্যাতিমান কবিদের অসংখ্য কবিতা। 

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর