কালের পরিবর্তনে কদর হারাচ্ছে পাহাড়ের হস্তীদন্ত শিল্প। একটা সময় পার্বত্যাঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীদের প্রিয় ছিল হাতির দাঁতের তৈরি অলংকার ও কারুপণ্য। বিয়েতে যৌতুক কিংবা উপহার হিসেবে দেওয়া হতো হস্তীদন্তর হাতের বালা, চুলের কাঁটাসহ নানা সামগ্রী।
বিশেষ করে ঐতিহ্যগতভাবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, মুরং, খিয়াং, চাক ও খুমিরা এসব গহনা ব্যবহার করে থাকেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বিশ্বাস, হাতির দাঁতের অলংকার তাদের জীবনে সৌভাগ্য বয়ে আনবে। এমনকি, রাঙামাটির চাকমা রাজার হাতির দাঁতের তলোয়ারে বাঁট, চেয়ার, কালিন্দি রাণীর ব্যবহৃত খরম, বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধের আসনসহ, বুদ্ধমূর্তি, ফুলের টব হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি করা হতো। কিন্তু কালের পরিবর্তনে এখন এসব অনেকটা বিলুপ্ত প্রায়। তবে এ কুঁটির শিল্পকে বংশগত ঐতিহ্য হিসেবে এখনো ধরে রেখেছেন রাঙামাটির বিজয় কেতন চাকমা।
শুধু রাঙামাটি নয়, গোটা পার্বত্যাঞ্চলের মধ্যে একমাত্র বিজয় কেতন চাকমার হাতির দাঁতের উপর সুক্ষ নকশা আর কারুকাজে শৌখিন অলংকার বা ঘর সাজানোর শোপিস দেশে- বিদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এটা অবশ্য তাদের বংশের চার পুরুষের পেশা ছিল একটা সময়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে পার্বত্যাঞ্চলে হাতির দাঁতের কুটির শিল্পের জনক হিসেবে অতিপরিচিত মুখ ছিলেন ধলচান চাকমা। তিনি পরলোক গমনের পর তার ছেলে কল্পতরু চাকমা গজদন্ত শিল্পের উন্নতি সাধন করেন। তিনি ও তৎপুত্র প্রয়াত মোহনবাঁশী চাকমার তৈরি হাতির দাঁতের কাজ অত্যন্ত উৎকর্ষতা লাভ করে। দেশ-বিদেশে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি কর্তৃক প্রশংসিত হয়। তাদের বংশধর বিজয় কেতন চাকমা রাঙামাটি জেল রোডে কল্পতরু শিল্প নিকেতনে এ শিল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোয়ায় হস্তীদন্ত তৈরি অলংকার সামগ্রীর চাহিদা অনেকটা কমে যাওয়ায় এখন আগের মতো ব্যবসাও নেই তার।
রাঙামাটি হস্তীদন্ত শিল্পী বিজয় কেতন চাকমা বলেন, ১৯৬২ সালে বাবা মোহনবাঁশী চাকমার কাছে ছেলে বিজয় কেতন চাকাম প্রথম গজদন্ত কাজ শিখেন। তারপর থেকে কখনো বন্ধ করেননি এ কাজ। বিজয় কেতন চাকমার বাড়ির একপাশে করা হয়েছে কল্পতরু নিকেতন। ক্ষুদে হাতুড়ি বাটাল দিয়ে হাতির দাঁতের চমৎকার নকশার কারুশিল্প তৈরি করেন তিনি।
জানা গেছে, ১৯৭৬-৭৭ সালে রাঙামাটি জেল রোডে কল্পতরু নামক হাতির দাঁত শিল্প প্রতিষ্ঠান করেন বিজয় কেতন চাকমা। কল্পতরু নামক হাস্ত-দন্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্থান পায়।
বিজয় কেতন চাকমার বংশানুক্রমিক প্রতিভার অনন্য সাক্ষী রাঙামাটির কল্পতরু হস্তীদন্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত ধলচান চাকমার তৈরি দেড়শত বছরের পুরনো পাশা খেলার গুটি, তৎপুত্র কল্পতরু চাকমার তৈরি অলংকার রাখার বাক্স, তৎপুত্র মোহনবাঁশীর তৈরি বিরাট ফুলের ঠব। চতুর্থ পুরুষ বর্তমানে বিজয় কেতন চাকমার তৈরি বুদ্ধের জাতকের গল্প সংবলিত বর্মী পাখা। তাছাড়া হাতির দাঁত দিয়ে মেয়েদের প্রায় সব ধরনের সৌখিন অলংকার তৈরি করেছেন তিনি। কল্পতরু শিল্প নিকেতনে সংগ্রহে আছে কয়েক ধরনের চুলের কাঁটা, চিরুনী, আংটি, গলার হার, কানের দুল। ছেলেদের জন্য আছে টাই পিন, কোট পিন, কাফলিঙ্ক, টোবাকো পাইপ, সিগারেট হোল্ডার। এ ছাড়া আছে ছোট বড় নানা ধরনের শোপিস, হাত পাখা, বুদ্ধমূর্তি, হাতির প্রতিকৃতি, পেপার নাইফ, ছোট-বড় স্টিক, ফুল-লতা-পাতার নকশা।
হস্তীদন্ত শিল্প ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে হাতির দাঁত দুষ্প্রাপ্য বিধায় সীমিত আকারে এ শিল্পের কাজ চলছে। হাতির দাঁত না পেলে এ শিল্প টিকবে না। তাছাড়া এখন তো হাতির দাঁত পাওয়াই যায় না। তাছাড়া দাঁতের দাম অনেক বেশি। এ দাঁত দিয়ে অলংকার বানালে খরচ অনেক বেশি হয়। বিক্রি করে তেমন লাভ পাওয়া যায় না। কারণ আধুনিক অলংকারের যুগে হস্তীদন্ত তৈরি অলংকারের চাহিদা নেই।
বিডি প্রতিদিন/এমআই